• ঢাকা
  • বুধবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৫, ৩ বৈশাখ ১৪৩২
Bancharampur Barta
Bongosoft Ltd.

আধ্যাত্মিক সাধক রাহাত আলী শাহ


বাঞ্ছারামপুর বার্তা এপ্রিল ১৪, ২০২৫, ০৬:৫৫ পিএম আধ্যাত্মিক সাধক রাহাত আলী শাহ

বাংলাদেশ অলি আউলিয়া পীর ফকির গাউস কুতুবের দেশ। এদেশের প্রতিটি ধূলিকণার সাথে মিশে আছে কোন না কোন অলির পদ পরশ। যুগে যুগে এদেশে আগমন ঘটেছে বহু সাধকের, আবার এদেশেও জন্মগ্রহণ করেছে বহু অলি আউলিয়া। যাদের  পূণ্য পদচারণায় গর্বিত এ বাংলাদেশ। আর এদেশেরই একজন মহান অলি মুজাদ্দেদে জামান, গাউসুল আজম, মারিফতে কেবলা, চার তরিকার ফয়েজ প্রাপ্ত বেলায়েতের কর্ণধার, তরীকায়ে রাহাতিয়ার ইমাম, মাহবুবে খোদা, শাহান শাহ্ হযরত রাহাত আলী শাহ্ (রহ:)।
হযরত রাহাত আলী শাহ্ (রহ.) এমনই একজন অলি, যিনি ইসলাম প্রচার ও প্রসারে যথেষ্ট অবদান রেখে গেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম আধ্যাত্মিক সাধক হযরত রাহাত আলী শাহ্ (রহ.) ১২৭২ বঙ্গাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার মধ্যনগর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম ছিল আইনুদ্দিন মোল্লা এবং মায়ের নাম ছিল আয়না বিবি। পিতা মাতা উভয়ই ছিলেন খুবই ধার্মিক ও পরহেজগার। বাল্যকাল হতেই হযরত রাহাত আলী শাহ্ (রহ.) এর ধৈর্য ও সংযম সবাইকে আকৃষ্ট করে। রাহাত আলী শাহ (রহ.) ছিলেন একজন অলি। কথিত আছে ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই তিনি তার মাকে ধরাধামে আগমনের তারিখ জানিয়ে দিয়েছেন। 
শীতের শেষে বসন্ত আসি আসি করছে। ঠিক এমনি সময়ে এক রাত্রি শেষে পূর্ব দিগন্ত ফর্সা হয়ে ক্রমশ: রক্তিম বর্ণ ধারণ করতে যাচ্ছে। যাকে বলে সুবেহ সাদেক। এমনি সময় মধ্যনগর গ্রামের আইন উদ্দিনের স্ত্রী প্রসব ব্যথায় খানিকটা কোকিয়ে উঠলেন। চারদিক থেকে সমস্বরে মসজিদ থেকে ভেসে আসছে আজানের মধুর “আল্লাহু আকবর” ধ্বনি। ঠিক সে সময়ে ঘর আলো করে এক টুকরো নূরের আলোর মত জন্ম নিলেন রাহাত আলী শাহ্। সন্তানের রূপে মুগ্ধ হয়ে মা ভুলে গেলেন দশ মাসের কষ্ট ভোগ এবং প্রসব যন্ত্রণা। আইনউদ্দিন মোল্লা যথা নিয়মে দ্বিতীয় পুত্রের আকিকা করে নাম রাখলেন আবদুল আলীম ওরফে রাহাত আলী। মা রাহাত আলী নামেই বেশী ডাকতেন। অপরিসীম স্নেহ, মায়া মমতা নিয়ে পিতা মাতা এবং পিতৃব্যদের আদর সোহাগে বড় হতে থাকে শিশু রাহাত আলী। শৈশব থেকেই তার মধ্যে ব্যতিক্রম কিছু লক্ষ্য করা যায়। যে দেখে সেই মুগ্ধ হয়ে যায়। কোন কান্নাকাটি নেই। যে হাত বাড়য় তার কোলেই লাফিয়ে পড়ে। যে কেউ তাকে কোলে নিয়ে অনুভব করেন এক স্বর্গীয় সুখ। শৈশব পেরিয়ে হাটি হাটি পা পা করে এগিয়ে যায় বাল্যের দিকে। সঙ্গী জুটে যায় আরও ক’জন বালক। তাদের সাথে খেলতে যায়, বেড়াতে যায় কিন্তু কি যেন একটা অনুভূতি তাকে উদাস করে রাখে। খেলতে যেয়ে হয়তো প্রকৃতির মধ্যে কিছু একটা খুঁজে বেড়ায়, উদাস উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। তারপর হয়তো এক সাথীর ডাকে আবার ফিরে আসে। ছেলের এহেন মনোভাব পিতামাতার মনেও ভাবান্তর এনে দেয়। তারা সিদ্ধান্ত নেয় রাহাত আলীকে মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত করবেন বলে। 
শাহান শাহ্ হযরত রাহাত আলী শাহ্ এর শিক্ষা জীবনী: কথা বলতে শেখার পর থেকেই বাবা মায়ের কাছেই শুরু হয় তার আরবী শিক্ষা। খুব অল্প দিনের মধ্যেই সে কালেমা সহ বেশকিছু সুরা মুখস্ত করে ফেলে। আর তারপর নিজ থেকেই বাবা মায়ের সাথে দেখাদেখি নামাজ পড়তে শুরু করে। তারপর মক্তবে ভর্তি করানো হয় তাকে। কিছুদিনের মধ্যেই সে কায়দা ও আমপারা শেষ করে কোরআনের সবক নেয়। পড়াশুনায় গভীর উৎসাহ দেখে মক্তবের শিক্ষকরা তার প্রতি সহজেই আকৃষ্ট হয়। আকৃষ্ট হয় তার মায়াবী মিষ্টি চেহারা এবং তার আচার ব্যবহার দেখে। শিক্ষকদের ভাবতে কষ্ট হয় না এ ছেলে ভবিষ্যতে একদিন আলেম ব্যক্তিতে পরিণত হবে। তারাও তার প্রতি বিশেষ যত্ন নিতে থাকেন। মক্তবের শিক্ষার পাশাপাশি রাহাত নিজ উদ্যোগে কোরআন হেফজ করার চেষ্ট চালাতে থাকে এবং এ ব্যাপারে বেশকিছু অংশ মুখস্থও করে নেয়। 
শাহান শাহ্ হযরত রাহাত আলী শাহ্ এর আচার আচরণ, আকৃতি ও কথাবার্তা: শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন খুব শান্তশিষ্ট। কথা বলতেন খুবই কম। টানা টানা বড় দুটো চোখে তার চাহনী ছিল উদাস উদাস, অথচ গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। পাড়া পড়শী, মুরব্বী ও শিক্ষকদের প্রতি ছিল তার গভীর শ্রদ্ধাবোধ। বাল্যকাল থেকে মজনু হালত প্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত কেউ তাকে এক ওয়াক্ত নামাজও কাজা করতে দেখেনি। যৌবনে তিনি ছিলেন বেশ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। দেহ ছিল মার্জিত বলিষ্ঠ ও দোহারা গড়নের। উচ্চতা ছিল প্রায় ছ’ফুটের মতো। গায়ের রং ছিল কাঁচা হলুদের মতো উজ্জ্বল। উন্নত নাক। বুকে, পিঠে ও হাতে বড় পশম। গাল ভর্তি দাঁড়ি। বার্ধক্যে তার আধা পাকা চুল আর দাঁড়ি ছিল ধবধবে সাদা। 
শাহান শাহ্ হযরত রাহাত আলী শাহ্ এর পোশাক: মজনু হালাতে তার পোষাক আশাকের তেমন কোন বালাই ছিল না। একটা লুঙ্গি কেউ পড়িয়ে দিলে তাই পরণে থাকতো। উর্ধাঙ্গ থাকতো কালি। মাঝে মধ্যে হয়তো একটা ফতুয়া বা পাঞ্জাবী কেউ শরীরে পরিয়ে দিলে তা শরীরে থাকতো কিছুক্ষণ। মাঘ মাসের প্রচন্ড শীতেও তিনি খালি গায়ে থাকতেন। কেউ রাতে গায়ে কাঁথা দিয়ে দিলে পরদিন তিনি তা পানিতে ভিজিয়ে রাখতেন দিনভর। পরদিন রাতে সে ভেজা কাঁথা গায়ে দিতেন। মাঝে মাঝে পায়ে পড়তেন চটি জুতা। মাঝে মধ্যে খড়ম।শাহান শাহ্ হযরত রাহাত আলী শাহ্ এর খাওয়া দাওয়া: খাওয়া দাওয়ার প্রতি রাহাত আলী শাহ্ ছিলেন নিস্পৃহ। চেয়ে কোন কিছুই তিনি খাননি কোনদিন। খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে তার কোন ধরা বাঁধা সময়ও ছিল না। যদিও বা মাঝে মধ্যে ভক্তবৃন্দের পীড়াপীড়িতে আহারে বাধ্য হতেন, তাও ছিল খুবই পরিমিত বা নাম মাত্রও বলা যেতে পারে।
শৈশবকাল থেকেই তার নানা অলৌকিক কেরামতি প্রকাশ পেতে থাকে। শৈশবেই মসজিদভিত্তিক স্থানীয় মক্তবে তাকে ভর্তি করা হয়। তখন থেকেই তিনি ছিলেন শান্ত প্রকৃতির এবং বেশ ধৈর্যশীল। লৌকিকভাবে হাফেজী পড়া না পড়েও তিনি কোরআনে হাফেজ ছিলেন। মক্তবে পড়া সম্পন্ন করে তিনি সরাইলের নাসিরনগর মাদরাসা ও ভারতের বিখ্যাত দেওবন্দ মাদরাসায় লেখাপড়া করেন। এ সময় কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার পীর কাশিমপুর গ্রামের হযরত নাজিমুদ্দিন চিশতি (রহ.) তার সহপাঠি ছিলেন। তিনি বলেছেন, মাদরাসার ছাত্র থাকাকালীন সময়ে রাহাতের মধ্যে তিনি অলৌকিক কার্যক্রম দেখতে পান। রাহাত সময়মতো ক্লাসে যেতেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই দেখতে পেতেন রাহাতের বসার স্থানটি শুন্য। টেবিলে কেবল বইখাতা পড়ে আছে। কিন্তু শিক্ষক ও ছাত্ররা এ ঘটনা টের পেত না। অন্য এক সূত্রে জানা যায়, এ সময়ে অলৌকিকভাবে রাহাত পাকিস্তানের এক মাদরাসায় অধ্যয়ন করেছেন। রাহাত যখন জমাত উলার ছাত্র ঠিক সে সময় লজিং বাড়িতে তিনি থাকতেন এবং সে সময়ই তার অলৌকিক রূপটি প্রকাশ পেয়ে যায়। একদিন লজিং মাস্টার অমাবস্যার রাতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ঘর থেকে বের হয়ে দেখতে পান, আকাশ থেকে একটি নূরের বিশাল রশ্মি যেন রাহাতের ঘরটিকে আলোকিত করে রেখেছে। আকাশ এবং মর্তের মধ্যে তৈরি হয়েছে নূরের পথ। আর রাহাত জিকিররত অবস্থায় সেই জ্যোতির্ময় ঘরে দাঁড়িয়ে আছে। লজিং মাস্টার ঘরে প্রবেশ করতেই আলো নিভে যায় এবং রাহাতও সেখান থেকে উধাও হয়ে যান। এরপর প্রায় এক যুগ লোকালয়ে তাকে দেখা যায়নি। জানা যায়, এ সময় তিনি ভারতের কোন এক গভীর জঙ্গলে আধ্যাত্মিক ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। কথিত আছে এ সময় তিনি অলৌকিকভাবে হযরত খাজা খিজির (আ.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তার কাছ থেকে মারেফাতের উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি অলৌকিকভাবে ইমাম হযরত বড়পীর আবদুল কাদির জিলানী (রহ.), হযরত খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি (রহ.), হযরত মুজাদ্দেদ আলফেসানী ও হযরত নফসবন্দী (রহ.)-এর দিদার লাভ করে ফায়েজপ্রাপ্ত হন। এর পরবর্তী সময়ে তিনি লোকালয়ে ফিরে আসেন এবং সহজ সরল জীবনযাপন করতে থাকেন। মূলত হযরত রাহাত আলী শাহ (রহ.) ছিলেন বাকাবিল্লার অনুসারী একজন উচুমানের অলি এবং তার আধ্যাত্মিকতায় মিশে ছিল চার তরিকার ফয়েজের ফল্গুধারা, যাতে মিশে ছিল তরিকায়ে রাহাতিয়ার মূলমন্ত্র। তার আরাধনার মূলমন্ত্র ছিল আমিত্বকে বিলীন করে পরম সত্তার সাথে একাত্ম হওয়া। তিনি দুনিয়াদারির সব চাওয়া পাওয়ার ঊর্ধ্বে ছিলেন। তিনি কখনো কারও দেয়া জিনিস নিতেন না এবং নজর নেয়াজ খেতেন না। দৈবাৎ কারও পীড়াপীড়িতে  কোন জিনিস যদি মুখে দিতেন, তবে তা হয়ে যেত বিশেষ কোন কেরামতির অংশ। তিনি ছিলেন সকল ধরনের কামনা বাসনার ঊর্ধ্বে থাকা চিরকুমার এক মহান মজ্জুব অলি।
এ মহান আধ্যাত্মিক সাধক বাংলা ১৩২৫ সালের ১৮ শ্রাবণ রোজ বৃহস্পতিবার ইহলোক ত্যাগ করেন। তিনি যে স্থানে মারা যান সে স্থানের সন্নিকটেই মাছিমনগরে তার দাফন সম্পন্ন হয় এবং ভক্তদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সেখানে গড়ে তোলা হয় মাজার শরীফ। মাজারকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীতে গড়ে উঠেছে শাহ রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয়, শাহ রাহাত আলী কলেজ, শাহ রাহাত আলী দাখিল মাদরাসা এবং একটি বৃহৎ মসজিদ। মাজারের আয় থেকে এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। এ মাজার এখনও ওই এলাকার জ্ঞানচর্চা ও আধ্যাত্মিক চর্চার প্রাণকেন্দ্র। প্রতি বছর ১৩ থেকে ১৯ শ্রাবণ লাখ লাখ ভক্ত ও আশেকানের উপস্থিতিতে ওরস উদযাপিত হয় এবং ওফাতের ৪০তম দিনে উদযাপিত হয় চল্লিশা ওরস। এ মহান সাধকের কর্ম ও জীবন হোক আমাদের চলার পথের পাথেয়।
যাতায়াত : বাংলাদেশের যে কোন জায়গা থেকেই বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় যাওয়া যায়। বাঞ্ছারামপুর উপজেলা সদর থেকে রিক্সা অথবা অটোতে আধ্যাত্মিক সাধক রাহাত আলী শাহের দরগায় যাওয়া যায়।

Side banner