রমজান এক গভীর আধ্যাত্মিক মাস, যা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন আচার ও রীতি-নীতি পালন করার মাধ্যমে উদযাপিত হয়। আজকের প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে রমজান মাস উদযাপনের অনন্য ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ওপর।
১. মিসর: ‘ফানুস’ উৎসব মিসরের রমজান অত্যন্ত জনপ্রিয়, বিশেষ করে ‘ফানুস’ উৎসবের জন্য। এটি বহু শতাব্দী ধরে রমজানের অন্যতম চিহ্ন হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। মিসরের মানুষ তাদের ঘরবাড়ি, দোকান এবং রাস্তাঘাট ফানুস দিয়ে সাজায়, যা রমজানের শুভ্রতা ও আনন্দের প্রতীক, বিশেষ করে মিসরের রাজধানী কায়রোতে রমজান মাসের শুরুর দিকে ঐতিহ্যবাহী রঙিন ফানুসের মেলা বসে।
২. সৌদি আরব: মসজিদভিত্তিক ইফতার ও ঐতিহ্যবাহী খাবার সৌদি আরবের মক্কা ও মদিনার পবিত্র মসজিদগুলোতে রমজান মাসে ইফতার একটি বিশেষ সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান। হাজার হাজার মুসল্লি একত্রে ইফতার করেন, যা রমজানের সৌন্দর্যকে আরো জাঁকজমকপূর্ণ করে তোলে। সৌদি আরবে রমজান মাসের খাবারের মধ্যে খেজুর, স্যুপ, সাম্বুসা এবং আরবি কফি অন্যতম। এর মধ্যে সাম্বুসা বিশেষভাবে জনপ্রিয়, যা মূলত মাংস বা সবজি দিয়ে তৈরি একটি স্ন্যাকস।
৩. লেবানন: কামানের শব্দে ইফতার ঘোষণা লেবাননসহ মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে রমজান মাসে কামান দাগানো হয়, যা ইফতার এবং সাহরি সময়সূচি ঘোষণা করে। মূলত, এটি মিসরের ঐতিহ্য থেকে শুরু হয়ে অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। কামানের শব্দের মাধ্যমে রমজান মাসের প্রতিদিনের ইফতার ঘোষণা করা হয় এবং এটি মুসলিমদের জন্য এক আবেগপূর্ণ সময় হয়ে ওঠে।
৪. সংযুক্ত আরব আমিরাত : ‘হক আল লায়লা’ উৎসব সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিশেষভাবে ‘হক আল লায়লা’ উৎসব অনুষ্ঠিত হয় শাবান মাসের ১৫ তারিখে। এই উৎসবে শিশুরা বিশেষভাবে অংশ নেয়। তারা উজ্জ্বল পোশাক পরে প্রতিবেশীদের বাড়িতে গিয়ে মিষ্টি ও বাদাম সংগ্রহ করে। এটি একটি ঐতিহ্যগত উৎসব, যা রমজানের আগমনের প্রতি আনন্দ প্রকাশ করে।
৫. বাংলাদেশ ও ভারত: বাহারি ইফতার আয়োজন বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে রমজানের সময় বিভিন্ন ধরনের খাবার দিয়ে ইফতার আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশের রাস্তা, মসজিদ ও বাসাবাড়িতে ইফতার বিতরণ একটি ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। পিঁয়াজু, বেগুনি, ছোলা, জিলাপি, শরবত, খেজুর, হালিম—সবই এই অঞ্চলের জনপ্রিয় খাবার। ইফতারের মাধ্যমে মুসলিমরা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ বজায় রাখে।
৬. পাকিস্তান: সাহরি ডাক পাকিস্তানে, বিশেষত পেশাওয়ার ও কাশ্মীর অঞ্চলে সাহরির জন্য ‘সাহরি ডাক’ নামের একটি ঐতিহ্য প্রচলিত রয়েছে। যেখানে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত একদল ড্রাম বাজিয়ে সাহরি খাবারের জন্য মুসলিমদের ডেকে তোলে। এটি শুধু একটি রীতিই নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক সেলিব্রেশন হিসেবে পবিত্র রমজানকে স্বাগত জানানো হয়।
৭. ইন্দোনেশিয়া: ‘পাডুসান’ প্রথা ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপে, রমজানের আগে বিশেষভাবে ‘পাডুসান’ নামের একটি ঐতিহ্য রয়েছে। পাডুসান অর্থ গোসল করা। জাভানিজ মুসলিমরা ঝরনার পানিতে মাথা থেকে পা পর্যন্ত পুরো শরীর ডুবিয়ে রেখে এটি পালন করে। এই ঐতিহ্য অনুযায়ী, স্থানীয় মুসলমানরা নদী, ঝরনা বা সমুদ্রে স্নান করে নিজেদের পবিত্র করেন। এটি শুধু শারীরিক পরিচ্ছন্নতা নয়, আত্মিক পরিচ্ছন্নতা অর্জনের একটি উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়।
৮. মালয়েশিয়া : ‘পাসার রমাদান’ বাজার মালয়েশিয়া রমজান মাসে ‘পাসার রমাদান’ নামের বিশেষ বাজার আয়োজন করে। এখানে ইফতারের জন্য বিভিন্ন ধরনের মালয় খাবার, মিষ্টি, রুটি ও ফলমূল পাওয়া যায়। এই বাজারগুলো শুধু খাওয়ার জন্য নয়, বরং একটি সামাজিক জমায়েত হিসেবেও ব্যবহৃত হয়, যেখানে মানুষ একে অপরের সঙ্গে মিলিত হয়।
৯. সেনেগাল : ‘নডগু’ ইফতার সেনেগালে, ইফতারের সময় ‘নডগু’ নামে পরিচিত একটি প্রথা রয়েছে, যেখানে সমাজের সবাই একত্র হয়ে খেজুর, ফলমূল ও দুগ্ধজাত খাবার খেয়ে ইফতার করে। এটি সামাজিকতা ও সম্প্রদায়ের ঐক্য দৃঢ় করে এবং মুসলিমদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলে।
১০. মরক্কো: ‘নাফার’ দ্বারা সাহরির সময় ঘোষণা—মরক্কোতে ‘নাফার’ নামের বিশেষ একদল শিঙাবাজ সাহরির সময় মুসলমানদের জাগিয়ে তোলে। সাহরির জন্য প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসারে শিঙা বাজানো হয় এবং এটি একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় অনুষ্ঠান হয়ে দাঁড়িয়েছে।
১১. তুরস্ক: ঐতিহ্যবাহী ড্রাম বাজিয়ে সাহরি ঘোষণা—তুরস্কে রমজান মাসের প্রথম দিকে বিশেষ ড্রাম বাজানো হয়, যা সাহরির সময়সূচি ঘোষণা করে। ড্রামাররা বিশেষ পোশাক পরে এই ড্রাম বাজিয়ে সাহরি সময়ের কথা ঘোষণা করেন এবং এটি এক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তুরস্কের আরেকটি বিশেষ ঐতিহ্য হলো, রমজান মাসের প্রথম দিন, ইফতারের সময় কামান থেকে গোলা ছোড়া হয়। কামানের শব্দ শোনা মাত্রই ইফতার শুরু করা হয়, যা একটি অত্যন্ত পুরনো এবং সাংস্কৃতিক প্রথা। তুরস্কে এই রীতি সাধারণত ইস্তাম্বুলে পালন করা হয় এবং এটি একটি আধ্যাত্মিক এবং উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি করে
১২. যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র: পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম কমিউনিটির মধ্যে ইফতার আয়োজনে কিছুটা ভিন্নতা দেখা যায়। এখানে মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টারগুলোতে মুসলিমরা একত্রে ইফতার করে, যেখানে বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য অনুযায়ী খাবার ভাগাভাগি করে থাকে। এটি সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে একত্র করে এবং মুসলিম সমাজের ঐক্য প্রদর্শন করে।
বিশ্বব্যাপী রমজান উদযাপনের সময় নানা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, যা শুধু পার্থক্যই তুলে ধরে না, বরং মুসলিম সমাজের ঐক্য ও সহানুভূতির প্রতীকও। বিভিন্ন দেশের প্রতিটি সমাজে রমজান ভিন্ন রীতিতে পালিত হলেও মূল উদ্দেশ্য আত্মশুদ্ধি, সহানুভূতি এবং মানবতার কল্যাণ। (আল-জাজিরা, আল-আরাবিয়া, আল-কুদস আল-আরাবি ইত্যাদি)
আপনার মতামত লিখুন : :