আপনজনের স্পর্শ সমুদ্রের চাইতে গভীর আকাশের চাইতে বিশাল
আমার অনেক বন্ধুকে বলতে শুনি বিদেশে বা দেশের বাইরে কোথাও গেলে আত্মীয় এড়িয়ে যান। বলতে শুনি বেড়াতে গিয়ে দেখা সাক্ষাৎ ঝামেলার। যেমন আমার ঝামেলা তেমনি তাদেরও বিব্রত করা। আমার ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টো। দেশের বাইরে তো বটেই ঢাকার বাইরে কোথাও গেলেও আমি সময় সুযোগ থাকলে আত্মীয় বা বন্ধুর দেখা পেতে চাই। এরকম কোনো স্বজনের সাথে দেখা হলে আমার কাছে ভ্রমণটা পূর্ণ হয়েছে বলে মনে হয়।
এবারের মালদ্বীপ ভ্রমণ পুরোটাই ছিলো অন্যরকম। গিয়েছিলাম আমার বন্ধু ড. তানভীর নাসরিনের আমন্ত্রণে। ওর মালের বাসাতেই উঠেছিলাম। তাই বলা যায় আমি এবার পুরো ভ্রমণেই ছিলাম কাছের মানুষের কাছে। কিন্তু আমার এ ভ্রমণ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠেছিলো আমার ভাগনি মুনা ও তার পরিবারের সাথে বহু বছর পর মিলনের আনন্দে। মালেতে যাবার পরপরই হলুমালেতে একদিন স্বল্প সময়ের জন্য সাক্ষাৎ হয় মুনার সাথে। মুনা আমাদের আমন্ত্রণ জানায় রাতের ডিনারে। ও হাসপাতাল থেকে একঘন্টার ছুটি এনেছে। এই এক ঘন্টার জন্য ওকে ডিনার টাইম আর টি টাইম দুটোকে একসাথে লিাতে হয়েছে। খুবই দামী সময় এই এক ঘন্টা। হলুমালের বিচের সৌন্দর্য উপভোগের পর আমি আর তানভীর মুনার আমন্ত্রণে যাই ম্যানহাটান ফিস মার্কটে। ওখানে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কেদে ফেলি। একঘন্টা আমাদের মুখ বন্ধ থাকে না এক সেকেন্ডের জন্যও। আমরা ডিনার করি। মুনা আমাদের মালদ্বীপের সামুদ্রিক মাছ খাওয়ায়। কিন্তু সেই সাক্ষাৎ আমাদের তৃপ্তি দেয় না আবার দেখা হবার তৃষ্ণা বাড়ায় শুধু।
মাফুসি থেকে ফেরার পরদিন আবার ডিনারের দাওয়াত পাই মুনার বাসায়।
রাত আটটার পর আমি, তানভীর আর অবু রওয়ানা হই মুনার বাসার উদ্দেশ্যে। এক শহর থেকে আরেক শহর তবু সময় লাগে আধাঘন্টারও কম। হলুমালেতে যাবার জন্য ব্রিজ তৈরি হয়েছে ২০১৬ সালে। তার আগে অবশ্য যেতে হতো নৌ-পথে। এই ব্রিজে আমি প্রথমদিনই উঠেছি। এয়ারপোর্ থেকে এই ব্রিজ দিয়েই ঢুকতে হয় মালেতে। এয়ার পোর্র পাশ দিয়ে ব্রিজের ওপর দিয়ে চলছি হলুমালেতে। রাতের অন্ধকারে সমূদ্র অন্ধকারে ঢাকা। শুধু রুপালি রেখার ঢেউ বলে দেয় এখানে সমূদ্র আছে তার বুকে খেলে চলছে ঢেউয়ের খেলা। মুনার বাসার ঠিকানা তানভীরকে দেয়া। কারণ ওরা চিনে নিয়ে যাবে। শুধু শহর আর সমুদ্র দেখা ছাড়া আমার আর কোনো দায়িত্ব নেই। হলুমালে শহরটার দিকে তাকিয়ে বলে দেয়া যায় শহর খুব পুরনো নয়। বেশ গুছানো ভাবে হাইরাইজ তৈরি করা হয়েছে। বিল্ডিংগুলোর অবয়ব সুন্দর। জানা গেলো এগুলো চায়নিজরা বানিয়ে দিয়েছে। মালদ্বীপের বিদায়ী সরকারের সাথে চীনের ভালো সম্পর্ক ছিলো। এগুলো তার স্বাক্ষর বহন করে।
খুব সহজেই পাওয়া যায় মুনার বাসা। মুনা নিচে নেমে এসে আমাদের নিয়ে যায়। লিফটে করে নিয়ে যায় আমাদের। খুব সুন্দর গোছানো বাসা মুনার। মুনার বাসা যে খুব সুন্দর হবে সেটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম কারণ ও খুব শৌখিন মেয়ে। ঢাকায় ওদের বাসা ছিলো রড় এবং খুবই রুচিশীল ভাবে গোছানো । মুনা নিজেই অত্যন্ত সংস্কৃতিমনা , নাচে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত । ওর মা আমার খালাতো বোন আসমা আপা বাংলা সাহিত্যে এম.এ। খুব নরম মনের খুবই শৌখিন মানুষ আর বাবা কাজী জহিরুল আযম ছিলেন ডেসার সদস্য ( প্রকৌশল)। নিঃসন্দেহে বড় কর্মকর্তা । তবে আমার কাছে যেজন্য তিনি অধিক প্রশংসার দাবি রাখেন সেটি হচ্ছে একজন বড় ও ব্যস্ত কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও লেখালেখিতে নিজেকে সম্পৃত্ত রেখেছেন। বেশ ভালো ছোট গল্প লিখেন। তার তিনটি গল্পের বই রয়েছে। তো এরকম পরিবারের মেয়ে মুনার বিয়ে হয়েছে যার সাথে সেই জামাই রবিনও খুবই ভালো একজন ছেলে। সে এখন মালেতে ইন্দিরা গান্ধী হাসপাতালে সার্জারি বিভাগে চাকরি করছে। মুনা আছে হলুমালে হাসপাতালে। ডাক্তার দম্পতি ওরা। দুই মেয়ে। বড় মেয়েও ডাক্তার হবার লক্ষ্যে পড়াশোনা করতে গেছে মালয়েশিয়াতে। বরিনের মা একজন সংস্কৃতিমনা, খুবই কর্মঠ, যথেষ্ট মিশুক আর হাসিখুশি মানুষ। বরিনের বাবাও ছিলেন সিভিল সারভিসে যুগ্মসচিব হয়ে অবসর নিয়েছিলেন। এরকম একটি পরিবারের সবকিছুতেই রুচিশীলতার ছাপ পাওয়া যাবে এটাই স্বাভাবিক। আমরা ড্রইংরুমে বসে গল্পে মেতে গেলাম।
মালদ্বীপের কালচার নিয়ে কথা হলো। তানভীর এখানে তিন বছর, মুনারা প্রায় ছয় বছর সুতরাং ওরা খুব ভালো ভাবেই জানে এ দেশের মানুষ এবং সংস্কৃতিকে। মুনা বললো, মালদ্বীপকে সে একটা কারণে খুবি পছন্দ করে কারণ এখানে তেলবাজি নেই। আপনি কে বা কোনো পরিবারের আপনি কি মন্ত্রী নাকি সচিব তাতে ওদের কিছু যায় আসে না। ওরা ওদের মতো। প্রসঙ্গক্রমে সে একটা ঘটনার কথা বললো যে ওদের হাসপাতালে একবার প্রেসিডেন্ট এসেছিলো। মুনাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো প্রেসিডেন্ট স্বাগত জানাতে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট এত সাধারণ ভাবে এসছেন যে মুনা তাকে চিনতেই পারেনি। মুনার সামনে দিয়ে প্রেসিডেন্ট চলে গেছেন হাসপাতাল ভিজিটে। আর মুনা খুঁজে বেড়াচ্ছে প্রেসিডেন্ট কোথায়!
ঘটনাটা শুনে আমরা সবাই একসাথে বললাম আমাদের দেশে প্রেসিডেন্ট তো দূরে থাক তার খাসনামাকে অভ্যর্থনা জানাতেই তো লালগালিচা পাতা হয়। সে প্রসঙ্গেও মুনা বাংলাদেশে প্রধান মন্ত্রীর মালি আসার কাহিনী আমাদের শুনালো। সে কাহিনী অবশ্য আমার কাছে নতুন কিছু নয়। সরকারী চারকির সুবাদে বহু ধরনের জমকালো অভ্যর্থনার স্বাক্ষী গোপাল আমি নিজেই।
মালদ্বীপে চিকিৎসা সুবিধা সরকার দিয়ে থাকে। তাই হাসপাতালে অনেক রোগী আসে। প্রয়োজন না হলেও তারা ডাক্তার দেখাতে আসে। এটা তাদের কাছে বেড়ানোর জায়গার মতো আর্কষণীয়। সেই বিষয়েও অনেক গল্প বললো মুনা। মুসলিম দেশ হলেও ছেলে মেয়ের অবাধ মেলামেশা আর তার পরের নানা বিষয় নিয়েও অনেক গল্প জমা মুনার ঝুলিতে। সেগুলোর সাথে রুটিকে মাখন মাখানোর মতো মাঝে মাঝেই উপাদান যোগ করছিলো তানভীর। তাই গল্পের ভাগীদার যেন কাশ্মিরী ছেলে অবুও হতে পারে সেজন্য মুনা গল্পগুলো প্রথমে বাংলায় বলে ইংরেজিতে আবার অনুবাদ করে দিচ্ছিলো। প্রতিটা গল্প বলার আগে মুনা বলছিলো- আগে বাংলায় মজা করে বলে নেই। ওর এই বাংলায় মজা করে বলে নেই শুনে আমার মনে হলো – মোদের গরব মোদের আশা, আমরি বাংলা ভাষা ।
গল্পে রাত হয়ে গেলো। মুনার পরিবার থেকে তাগাদা এলো ডিনার করার জন্য।
প্রচুর আয়োজন করেছে বিয়াইন আর মুনা মিলে। এখানে ইন্ডিয়ান খাবার বেশ চলে বোঝা মুনার রান্না করা অসাধারণ পনিরের তরকারী খেয়ে। বেয়াইন চিকেন কাবাব করেছেন ওর ভেতরেও পনিরের টুকরা, দারিুন মজার । মাছের ভর্তা সালাদ চিকেন, পটল ভাজি, সবজি, চিংড়ি ফ্রাই এরকম আরো মখরোচক খাবারে গলা পর্যন্ত খেয়ে আবার ডের্জাট তারপর আমাদের খাবার পালা শেষ হলে ছবি তোলার পালা। বিয়াইন ভালো রান্না করেন সেটা জানতাম আজও তার রান্না খেয়েছি কিন্তু মুনার করা রান্না আমাকে একই সাথে অবাক এবং মুগ্ধ করলো। ও খুব আদরে বড় হওয়া একটা মেয়ে। হাসপাতাল থেকে ফিরে কখন রান্না করলো এতো মজার খাবার। কি সুন্দর মোমবাতি দিয়ে সাজালো টেবিল। সময় মানুষকে কিভাবে গড়ে নেয় তা যেন আরো একবার মনে করিয়ে দিলো আমায়।
খাবার আর ছবি তোলার পালার পর আবারো গল্প চললো আমার
রবিনের দিকে তাকিয়ে বললাম- তোমরা কি এ দেশে থেকেই যাবে? ভালো লাগছে তোমাদের?
রবিন বললো- হ্যাঁ ভালো লাগছে। থাকি আরো, দেখি কি হয়! দেশে তো ডাক্তারদের কদর নেই।
বাংলাদেশের প্রাইভেট সেক্টরেই বোধহয় বিশ্বের সবচেয়ে কম বেতন দেয়া হয় ডাক্তারদের।
এই একই ক্ষোভ একই ভাবে ঝরে পড়েছিলো লাসফুনো বিচে ভারত মহাসাগরের তীরে বেশ কজন তরুণ ডাক্তারের কন্ঠে। যারা মালদ্বীফ এসেছে ভাগ্য পরিবর্তনে। তারা তাদের চাকুনি , বেতন অঅর চাকুরির পরিবেশ নিয়ে খুশি । কিন্তু দেশে নামকরা ক্লিনিক আর প্রাইভেট হাসপাতালগিুলেঅতে তাদের বেতন ছিলো খুবই কম। তাদের কাছেই প্রথম জানতে পেরেছিলাম বাংলাদেশের স্কয়ার , ল্যাবএইড এবং এ ধরনের প্রাইভেট হাসপাালগুলেঅতে একজন ডিউটি ডাক্তারের বেতন মাত্র ৩০০০০ হাজার টাকা। অথচ এই ডাক্তার বানাতে প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজে পড়াতে তাদের পরিবারগুলোর খরচ হয়েছে লাখ লাখ টাকা।
বাংলাদেশের ডাক্তাররদের এই বেতনের সাথে কিছুতেই মেলানো যাচ্ছে না প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকে রাগীদের চিকিৎসা করানোর ব্যয়। লাগামছাড়া ব্যয় হয় রোগীদের। আইসিইউতে একজন রোগীর প্রতিদিনের খরচ পড়ে যায় লাখ টাকা। অথচ খরচের খাতগুলো অস্পষ্ট। তাহলে কি শোষণ হচ্ছে দু দিকেই ? একদিকে ওখানে কাজ করা ডাক্তাররা নায্য বেতন পাচ্ছে না, অন্যদিকে রোগীদের লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে।
অনেক গল্প শেষে রাত এগারোটারও বেশি হলে আমরা বিদায় নেবার জন্য প্রস্তত হই। এর মধ্যে আপার হাতে তুলে দিয়েছি আমার সবচেয়ে বড় সম্পদ আমার বই। আপা জানালেন তিনি আমার গল্পের সাথে পরিচিত। ভালো লাগে আমার গল্প। ব্যস এটুকু প্রশংসা শুনেই আমার মন ভরে যায়। একজন লেখকের এটুকুই সবচেয়ে বড় পাওয়া।
ফেরার আগে আবার বুকে বুক মেলাই আপার সাথে , মুনার সাথে। আহ্ কি যে সুখ। প্রিয়জনের স্পর্শ সমুদ্রের চাইতে গভীর আকাশের চাইতে বিশাল
এই প্রিয় স্পর্শ নিয়ে আবার গভীর কালোয় ঢাকা সমুদ্র আর সাদা রেখার ঢেউ দেখে দেখে ফিরতে থাকি মালেতে। আবার বুকের ভেতর কিন্তু তখন একটা বিষাদের মেঘ আটকে আছে গলার মাছের কাটা বিঁধে থাকার মতো। ভালো মেধাবী ডাক্তাররা যোগ্য বেতন পাচ্ছে না। চলে যাচ্ছে বিদেশে। আর দেশের রোগীরা জমি বেচে চিকিৎসা করছে। এই অরাজক পরিস্থিতি দেখার দায়িত্ব কাদের! হাসপাতাল নামক কসাইখানা থেকে মুক্তি কি করে মিলবে এই প্রশ্ন ভেতরটাকে ঘুণপোকার মতো কাটতে থাকে।
(আমার অনেক বন্ধু মালদ্বীপ ভ্রমণ নিয়ে আমার লেখাগুলো ফেসবুকে পড়তে চেয়েছিলেন, তাদের জন্য এ ভ্রমণ কাহিনীর অংশবিশেষ)
আপনার মতামত লিখুন : :