অবশেষে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার দরিয়াদৌলত ইউনিয়নের মরিচাকান্দি গ্রামের উজ্জ্বল মোল্লা ওরফে কানা উজ্জ্বল। সোমবার (২৮ অক্টোবর) বিকালে বাঞ্ছারামপুর থানা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। তিনি মরিচাকান্দি গ্রামের মিজানুর রহমান মিজানের ছেলে। বর্তমানে তিনি দরিয়াদৌলত ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসী কানা উজ্জ্বলের গ্রেফতারের খবর শুনে এলাকাবাসী মিষ্টি বিতরণ করেছে। একসময়ের হতদরিদ্র অটোচালক কানা উজ্জ্বলের উত্থান স্থানীয় এমপি ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলামের ভাগিনা জনির হাত ধরে। ২০০৯ সালের পর রাতারাতি উত্থান হয় কানা উজ্জ্বলের। শুরুর দিকে ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলামের নোংরা রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হন তিনি। তারপর ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর এমপির ভাগিনা জনির সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে কানা উজ্জ্বল। রাতারাতি ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটে। প্রথমদিকে ইব্রাহিমদের সাথে মিলে শুরু করেন মাদক ব্যবসা। তারপর মেঘনায় অবৈধভাবে বালি উত্তোলন। মরিচাকান্দি লঞ্চঘাট, ট্রলারঘাট, বাজার, পেট্রোবাংলার জমিসহ সবই দখল করে নেন কানা উজ্জ্বল। একই সাথে শুরু করেন বেপরোয়া চাঁদাবাজি, মাস্তানী, সন্ত্রাসী, মেঘনায় ডাকাতি; বলতে গেলে হেন অপকর্ম নেই যা তিনি করেননি। আর এসবের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বাঞ্ছারামপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী জাদিদ আল রহমান জনি চেয়ারম্যান। উত্তরাঞ্চলে জনি চেয়ারম্যানের অবৈধ টাকা কালেকশন করতেন কানা উজ্জ্বল। তাছাড়া তিনি হুন্ডি ব্যবসার সাথেও জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম বিজয়ী হলে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন কানা উজ্জ্বল। তার অত্যাচার নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে বিএনপি জামায়াতের লোকজন। ওই এলাকার বিএনপি পরিবারের কোন লোকজন বিদেশ থেকে বাড়িতে এলে কানা উজ্জ্বলকে টাকা দিতে হতো। এমনকি বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদলের কেউ বিয়ে সাদী করলেও তাকে টাকা দিতে হতো। শুধু বিএনপি নয়, কানা উজ্জ্বলের মাধ্যমে ওই এলাকার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও চরম নির্যাতনের শিকার হন। নিজ দলের প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে হামলা মামলা, ভয়ভীতি দেখিয়ে এলাকার আধিপত্য বিরাজ করতে থাকেন। জবরদখল, লুটপাট সহ নানাবিধ অপকর্মের কারণে বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় আলোচনা সমালোচনায় থাকতেন কানা উজ্জ্বল। তার খুঁটির জোর ছিল এমপির ভাগিনা জনি চেয়ারম্যান। করোনার দুঃসময়ে মানুষ যখন ঘর থেকে বের হতে পারতো না, ওই সময় অবৈধভাবে মেঘনা নদী থেকে কোটি কোটি টাকার বালি উত্তোলন করে কানা উজ্জ্বল। তারপর সেই টাকা দিয়ে নরসিংদীর নিরো বাংলায় ৩টি বাড়ি, সাভারে ১০ বিঘা জমি, গাজীপুরেও জমি ক্রয় করেন। নিজের পৈতৃক ভিটায় কোটি কোটি টাকা খরচ করে ডুপ্লেক্স আলীশান বাড়ি করেন। আর ওই বাড়িতে ঢাকা, নরসিংদী থেকে কলগার্ল এনে আনন্দ স্ফূর্তি করার পাশাপাশি সারারাত মাদকসেবন করতেন। বাড়িটিকে জলসাঘর বানিয়েছিলেন। ভয়ে এলাকার কেউ টু শব্দ করতে পারতো না।
বাঞ্ছারামপুরের সাবেক এমপি ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম ও তার ভাগিনা জনি চেয়ারম্যানের বাসায় নিয়মিত দেশীয় শাক সবজী, হাঁস মুরগী, নানা প্রজাতির মাছ, গৃহপালিত খাসি এমনকি ফলমূল পর্যন্ত নিয়ে যেতো কানা উজ্জ্বল। আর সেই কারণেই উপজেলার উত্তরাঞ্চলে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতাদের নানাভাবে অপমান অপদস্ত করতেন ক্যাপ্টেন তাজ ও তার ভাগিনা জনি। তাদের চাটুকারিতা করেই অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছিলেন কানা উজ্জ্বল। তাছাড়া থানার দালালীর সাথেও সম্পৃক্ত ছিলেন। আসামী ধরিয়ে দেয়া, সাধারণ মানুষকে আসামী বানানোর ভয়ভীতি দেখিয়েও হাতিয়ে নিয়েছেন লক্ষ লক্ষ টাকা। মরিচাকান্দি জোনের সমস্ত মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা নিতেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগের পতন হলে বাঞ্ছারামপুরের অন্যান্য নেতাদের মতো নরসিংদীতে পালিয়ে যান কানা উজ্জ্বল। সোমবার মরিচাকান্দির আরেক মাদক ব্যবসায়ী তানসেন মিয়ার বাড়িতে আসার পর পুলিশের হাটে আটক হন তিনি। আর এতে জনমনে স্বস্তি নেমে আসে।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলার উত্তরাঞ্চলের মূর্তিমান আতঙ্ক কানা উজ্জ্বলের হাতে নির্যাতিত, নিগৃহিত, নিপীড়িত মানুষেরা তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছে।
আপনার মতামত লিখুন : :