• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২
Bancharampur Barta
Bongosoft Ltd.

মেডিকেল টেকনোলজিস্ট বদলিতে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য


বাঞ্ছারামপুর বার্তা | নিজস্ব প্রতিবেদক এপ্রিল ২৯, ২০২৫, ০২:২৯ পিএম মেডিকেল টেকনোলজিস্ট বদলিতে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য

গত বছরের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে আট মাসে দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠান থেকে বদলি করা হয়েছে সহস্রাধিক মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও ফার্মাসিস্ট। প্রায় প্রতিদিনই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এ ধরনের বদলির আদেশ জারি হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে রমরমা ‘বদলি বাণিজ্যের’ অভিযোগ উঠেছে।
চলতি বছরের প্রথম চার মাসে ৪২৫টি বদলির আদেশ হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে। এসব আদেশের প্রায় সবগুলোতে আছে একাধিক মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও ফার্মাসিস্টের বদলির আদেশ। এর আগের চার মাসেও এ ধারা চলে আসছিল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রশাসন শাখায় বদলি সংক্রান্ত কাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজে অগ্রাধিকার নেই। গভীর রাত পর্যন্ত চলে ফাইল চালাচালি। অভিযোগ রয়েছে, এটা নিয়ে লেনদেন হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। প্রতিজনকে বদলিতে দিতে হচ্ছে দুই থেকে তিন লাখ টাকা। এসব বদলি কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। সেই সিন্ডিকেটের সদস্যরা সবাই এখন কোটিপতি। সিন্ডিকেটের তালিকার বাইরে কোনো মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও ফার্মাসিস্টের বদলি হয় না, ফাইল নড়ে না অধিদপ্তরের।
স্বল্প সময়ের এই অস্বাভাবিক বদলির তথ্য, অর্থ লেনদেন এবং জড়িতদের নাম উঠে এসেছে রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে। রাষ্ট্রীয় ওই গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি রাজনৈতিক দল সমর্থিত মেডিকেল টেকনোলজিস্ট এবং ফার্মাসিস্টদের সংগঠন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এমট্যাব) কতিপয় নেতা ও হাসপাতাল ভিত্তিক কয়েকজন এ বদলি বাণিজ্য সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, বদলি বাণিজ্যে জড়িতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- এমট্যাবের কেন্দ্রীয় মহাসচিব বিপ্লব উজ জামান বিপ্লব, সিনিয়র সহ-সভাপতি খাজা মাঈনউদ্দিন মঞ্জু, সাংগঠনিক সম্পাদক হাফিজুর রহমান, সহ-সভাপতি রুহুল আমিন, যুগ্ম সম্পাদক সাইদুর রহমান সিদ্দিকী, কাজী মাসুম, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফার্মাসিস্ট নাসিরউদ্দিন আহমেদ রতন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিকদার মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন, নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের আসাদ উল্লাহ মিয়া, জাতীয় সংসদ মেডিকেল সেন্টারের নাজমুল সোহাগ, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মো. সোহেল, আইপিএইচ-এর টেকনোলজিস্ট নিয়াজ প্রমুখ। 
বদলি বাণিজ্যের এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, জুলাই অভ্যুত্থানের পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বিগত সরকারের সুবিধাভোগীদের অপসারণের দাবি এবং মহাপরিচালক, পরিচালকসহ (প্রশাসন) পদায়নকৃত কর্মকর্তাদের পদায়ন বাতিলের দাবিতে চিকিৎসকদের আন্দোলনে তাদের সহযোগী হিসেবে সম্মুখ সারিতে থেকে মিছিল মিটিংয়ে অংশ নেন এমট্যাব নেতাকর্মীরা। তখন থেকেই তারা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে প্রভাব বিস্তার করে আসছেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সংশ্লিষ্টরা জানান, দু-একটা ঘটনা ঘটতে পারে। তবে এমট্যাব নেতারা যে সুপারিশ নিয়ে আসেন সেটা স্বীকার করেন তারা।
এমট্যাব নেতারা গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টের কথা স্বীকার করে জানান, আগের সরকারের আমলে বঞ্চিতদের জন্য তারা সুপারিশ করে পদায়ন নিয়েছেন। তবে আর্থিক লেনদেন হয়নি বলে দাবি তাদের।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর বলেন, দুনিয়ার সব জায়গায় নেতারা কাজ করেন। ওখানে (টেকনোলজিস্টদের বদলি) কী করছে, সেটা নিয়ে আমরা কথা বলতে পারবো না। যারা করে তাদের সঙ্গে কথা বলেন। টেকনোলিস্টদের বিষয়টি আমার পর্যন্ত আসে না। এটা পরিচালকের (প্রশাসন) বিষয়। আমরা যেগুলো ভালো দেখি, করি। এর মধ্যে দু-একটা এরকম (লেনদেন) হতে পারে। তবে এমন কিছু হলে আমরা তদন্ত করে দেখতে পারি।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) এ বি এম আবু হানিফ বলেন, বদলির সংখ্যাটা কাগজ না দেখে বলতে পারবো না। আমরা যেসব বদলি করেছি, অধিকাংশ দরখাস্তের ভিত্তিতে। টাকার লেনদেনের বিষয়টি আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। আমি অবগত না।
এমট্যাবের নেতারা কি বদলির তদবির করেন? আপনার দপ্তরে যান? জবাবে তিনি বলেন, এরকম আরও অনেকেই আসে। সংগঠনের ব্যানারে ওরাও আসে।
গোয়েন্দা সংস্থার কোনো রিপোর্ট কি আপনাদের দেওয়া হয়েছে, বা আপনাদের অবহিত করেছে? জবাবে পরিচালক (প্রশাসন) বলেন, এরকম কোনো ফরমাল ইনফরমেশন আমাদের হাতে নেই।
দুদকের পক্ষ থেকে কোনো খোঁজ নিয়েছে? জবাবে পরিচালক (প্রশাসন) বলেন, দুদকের লোকজন আসছে। ওরা ঠিক কোন উদ্দেশ্যে আসছে জানি না। দুদকের টিম আমাদের অফিসে প্রায়ই আসে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে অধিদপ্তরে সংগঠিত সব কর্মকাণ্ডে এমট্যাব নেতারা জড়িত ছিলেন। তারা ছিলেন বেপরোয়া ও মারমুখী। তাদের চাওয়ার বাইরে কিছুই করার থাকে না কর্মকর্তাদের নাজেহাল হওয়ার ভয়ে।
অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, বিগত সরকারের আমলে ২০২৩ সালের জুলাই মাসে প্রায় ৯শ মেডিকেল টেকনোলজিস্টকে তাদের নিজ বিভাগের বাইরে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়োগ করা হয়। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে তারা তাদের সুবিধামতো হাসপাতালে বদলির জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। এমট্যাব নেতারা এ সুযোগে বদলি বাণিজ্যে নেমে পড়েন। তারা বিগত সরকার সমর্থক মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও ফার্মাসিস্টদের সুবিধাভোগী আখ্যা দিয়ে বদলি করে তাদের স্থলে নতুন লোক অর্থের বিনিময়ে পদায়ন শুরু করে। সাধারণ (রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয়) মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও ফার্মাসিস্টদের হয়রানির অভিযোগ রয়েছে এমট্যাব নেতাদের বিরুদ্ধে।
এছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে তারা সাধারণ টেকনোলজিস্টদের মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করছেন, না দিলে দেওয়া হচ্ছে বদলির হুমকি। আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের সংগঠন স্বাধীনতা মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পরিষদ ও বঙ্গবন্ধু মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতা যারা জুলাই গণআন্দোলনের বিরোধিতাকারী এবং আওয়ামী সমর্থক চিকিৎসক, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, নার্সদের শান্তি মিছিল ও সমাবেশে অংশগ্রহণকারী হিসেবে চিহ্নিত- তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে আগলে রাখার অভিযোগ রয়েছে এমট্যাবের শীর্ষ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে।
জামায়াতে ইসলামী সমর্থিত মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ফোরামের (এমটিএফ) নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা বলেন, এমট্যাব পেশিশক্তির বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে শুধু বদলি বাণিজ্যেই নিয়ন্ত্রণ করছে না, তারা মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশনকে (বিএমটিএ) এক সাবেক নেতার সহযোগিতায় জোর করে দখল করে নিয়ে সংগঠনটিকে এমট্যাবের ভার্সন-২ এ পরিণত করে পেশায় নৈরাজ্য সৃষ্টি করেন।
দুদকের একটি সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও ফার্মাসিস্টদের বদলি বাণিজ্যের অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের একটি দল কাজ করেছেন। অনিয়মের প্রমাণ পেলে জড়িতের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এমট্যাব নেতাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়টি মহাসচিব বিপ্লব উজ জামানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হ্যাঁ, আমরা শুনেছি, গোয়েন্দা সংস্থা থেকে এমন অভিযোগ করেছে। একজন আওয়ামী দোসরের বদলি সংক্রান্ত বিষয়ে প্রতিবাদ করায় সংক্ষুব্ধ হয়ে এমন অভিযোগ করা হয়েছে। বদলিতে অর্থনৈতিক লেনদেনে আমার সংগঠন জড়িত নয়। তবে কোনো ক্ষেত্রে প্রান্তিক পর্যায়ে নাম ভাঙিয়ে এক-আধজন করে থাকতেও পারে, সেটা আমাদের জানার বাইরে। অনেক সময় আমাদের দেশে নাম ভাঙিয়ে অনেক কিছু হয় না?
তিনি বলেন, আমাদের কিছু নেতাকর্মী নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছে দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে। তারা নানাভাবে হয়রানিমূলক বদলি হয়েছে। আবার অনেকের অনেক দূর-দূরান্তে পদায়ন হয়েছে। বিগত সরকারের আমলে সুবিধাজনক পদায়ন পায়নি। সে কারণে আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে নেতাকর্মীদের জন্য কিছু অনুরোধ ছিল।
এমট্যাব মহাসচিব বিপ্লব উজ জামান দাবি করেন, গত সাড়ে ১১ বছর আমিও সাসপেনশনে ছিলাম। এটা শুধু রাজনৈতিক কারণে। যেহেতু আমি বিএনপি অরিয়েন্টেড একটা সংগঠনে জড়িত, সে কারণে আমার সঙ্গে এমন আচরণ হয়েছে। আমাদের সংগঠনের সুপার ফাইভসহ সব স্তরের নেতা মিলে আমাদের ২৫০ থেকে ৩০০ নেতাকর্মী ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে এমন নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছে। সঙ্গত কারণেই সরকার পতনের পর তারা সুবিধাজনক পদায়ন নিয়েছেন।
এরা কিন্তু রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করা সক্রিয় নেতাকর্মী। এদের বদলির বিষয়ে আমরা প্রশাসনের কাছে গিয়েছি, সুপারিশ করেছি। প্রশাসনও রীতিমতো দু-তিনবার বোর্ড করে নিয়ম অনুযায়ী বদলি করেছে। নিজেদের নেতাকর্মীদের থেকে অর্থনৈতিক লেনদেন করার তো প্রশ্নই আসে না। আমার সংগঠনের কেউই বদলি সংক্রান্ত অর্থনৈতিক লেনদেনের সঙ্গে জড়িত নয়।
এমট্যাব মহাসচিব বলেন, অনেক বদলি হয়েছে অল্প সময়ে, এটার কারণ- করোনার সময় ১২শ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ হয়েছে। ওই সময় পরিচালকের (প্রশাসন) দায়িত্বে ছিলেন ডা. মো. শামিউল ইসলাম সাদী। তিনি যে ছেলের বাড়ি দিনাজপুর, তাকে পদায়ন দিয়েছেন কক্সবাজার। আবার যে ছেলের বাড়ি সিলেট তাকে দিয়েছেন পঞ্চগড়। প্রতিটি ছেলের সঙ্গে এমনই করেছেন। এর মধ্যে মন্ত্রণালয়ের মৌখিক নির্দেশনা ছিল দুই বছর না হলে বদলি করা যাবে না। এই সরকারের পতনের পরে শত শত ছেলে ডিজি অফিসে আসতো। তারা কান্নাকাটি হইচই করতো। তখন তাদের চিত্র তুলে ধরে মন্ত্রণালয়ে চিঠি লেখা হয়। তখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি দেওয়া হয়, তাদের বদলি করতে পারবে। তখন তাদের বদলি হয়েছে।

Side banner