সুস্থ জীবন সবার অধিকার। কিন্তু কিছু অসাধু প্রতিষ্ঠান মানুষের এই মৌলিক অধিকারের সুযোগ নিয়ে মুনাফা লুটছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ‘সেবা ডিজিটাল ডায়গনস্টিক সেন্টার’ এমনই একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে সেবার নামে চলছে প্রতারণা, অনিয়ম এবং আইন লঙ্ঘন।
সেবার নামে প্রতারণা:
প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘সেবা’ হলেও বাস্তবে এর সঙ্গে সেবার কোনো মিল নেই। তারা রোগীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করছে, অথচ পর্যাপ্ত সুবিধা দিতে ব্যর্থ। ‘ডিজিটাল’ শব্দটি নামের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও মেশিন ও যন্ত্রপাতি সেকেলে ও পুরোনো, যা নির্ভুল রিপোর্ট প্রদানে সম্পূর্ণ অক্ষম। ফলে রোগীরা ভুল রিপোর্টের ভিত্তিতে ভুল চিকিৎসা গ্রহণ করছেন, যা তাদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।
নিরাপত্তাহীন এক্স-রে ও আলট্রাসনোগ্রাম রুম:
সরকারি নিয়ম অনুযায়ী এক্স-রে ও আলট্রাসনোগ্রাম রুমের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গা থাকা বাধ্যতামূলক, কিন্তু সেবা ডিজিটাল ডায়গনস্টিক সেন্টার এই নিয়ম মানছে না। এসব পরীক্ষার কক্ষ এতটাই ছোট ও অপরিকল্পিত যে, রোগীরা অজান্তেই ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছেন।
এক্স-রে রুমের বিকিরণ রোগীদের স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে, বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের জন্য এটি অত্যন্ত ক্ষতিকর। অথচ এই ডায়াগনেস্টিক সেন্টার যথাযথ সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই পরীক্ষাগুলো পরিচালনা করছে।
রিপোর্টের মূল্য নির্ধারণেও অনিয়ম:
উপজেলা স্বাস্থ্য কমিটির নির্ধারিত মূল্য তালিকার সঙ্গে সেবা ডিজিটাল ডায়গনস্টিক সেন্টারের রিপোর্টের বিলের কোনো মিল নেই। তারা রোগীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছে, যা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের লঙ্ঘন।
পরিবেশ দূষণের ভয়াবহতা:
ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ব্যবহৃত রাসায়নিক ও রিএজেন্টের যথাযথ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নেই। তারা এসব ক্ষতিকর রাসায়নিক কখনও নদীতে ফেলে, আবার কখনও বা ছাদে উন্মুক্ত স্থানে পোড়ায়। যা আশেপাশের মানুষের জন্য নানাবিধ রোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং ওজোন স্তরের ক্ষতির মাধ্যমে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
ভ্রাম্যমাণ আদালতের জরিমানা, তবুও অনিয়ম অব্যাহত:
২০২৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর ভ্রাম্যমাণ আদালত এই প্রতিষ্ঠানকে নিয়ম লঙ্ঘনের দায়ে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করেছিল। কিন্তু জরিমানার পরও তারা পুনরায় অনিয়ম চালিয়ে যাচ্ছে। যেন তাদের দেখার কেউ নেই!
সরকারি হাসপাতালের নিয়ম ভঙ্গ ও দালাল চক্র:
সরকারি নিয়ম অনুযায়ী প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টারের একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু সেবা ডিজিটাল ডায়গনস্টিক সেন্টার এই নিয়ম মানছে না। তারা সরকারি হাসপাতালের মাত্র ১০ গজের মধ্যেই অবস্থিত, যা আইন লঙ্ঘনের শামিল।
এছাড়া, সরকারি হাসপাতালের ভিতরে ও বাইরে দালাল নিয়োগ করা হয়েছে। তারা রোগীদের বিভ্রান্ত করে এই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠানোর চেষ্টা করে। এতে রোগীরা ভুল সিদ্ধান্ত নেন এবং অর্থ ও স্বাস্থ্য দুই ক্ষেত্রেই ক্ষতিগ্রস্ত হন।
অদক্ষ টেকনিশিয়ান ও সাধারণ কর্মীদের দিয়ে পরীক্ষা পরিচালনা:
আইন অনুযায়ী, একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিচালনার জন্য দক্ষ টেকনিশিয়ান ও প্রশিক্ষিত নার্স থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু সেবা ডিজিটাল ডায়গনেস্টিক সেন্টার এই নিয়ম মানছে না। তারা সাধারণ ও অদক্ষ ব্যক্তিদের দিয়ে পরীক্ষা পরিচালনা করাচ্ছে, যা রিপোর্টের মান ও রোগীদের নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে।
প্রশাসনের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন:
এই ধরনের অনিয়ম ও প্রতারণার বিরুদ্ধে প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে নিয়মিত তদারকি ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
স্বাস্থ্যসেবার নামে প্রতারণা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। রোগীদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছে সচেতন মহল।
আপনার মতামত লিখুন : :