রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্থানীয় রোগীদের ভিড়ে একসময় মুখরিত থাকতো রেলওয়ে হাসপাতাল লালমনিরহাট। কিন্তু এখন অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকায় এই হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বর্তমানে উন্নত স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার নেই কোন বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি। ওষুধ থাকলেও তার সুবিধা তেমন পাননা রোগীরা। চিকিৎসক ও অন্যান্য কর্মরত পদ সংকটসহ নানান কারণে সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত এ অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ। বর্তমানে ইন্ডোর চিকিৎসাসেবা বন্ধের উপক্রম হয়ে আছে। আউটডোর ও জরুরি চিকিৎসাসেবা চালু থাকলেও সেটি নামেমাত্র।
জানা যায়, এখানে সপ্তাহে সামান্য কিছু রোগী হাসপাতালটির বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসেন, আর ইনডোরের অবস্থা খুবই শোচনীয়। ৩২ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালটিতে দুই এক জন রোগী ভর্তি হন মাঝে মধ্যে।
রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্থানীয়রা জানায়, লালমনিরহাট রেলওয়ে হাসপাতালে চিকিৎসক ও জনবল সংকটের কারণে তাদের এই হাসপাতালের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা সেবা নিতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতির জন্য চিকৎসক ও জনবল সংকটকে দায়ী করেছেন তাঁরা। এমতাবস্থায় অনতিবিলম্বে জনস্বার্থে হাসপাতালের সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন ।
স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী (৫৪) বলেন, হাসপাতালের ভেতরে অধিকাংশ দরজা তালাবদ্ধ থাকে। মাঝে মাঝে খোলা হলেও হাসপাতালে তেমন কোনো কার্যক্রম নেই। হঠাৎ কখনো তালা খোলা থাকলেও ভেতরে গিয়ে দেখা যায় মাঠে গরু-ছাগল চড়ানো হচ্ছে। হাসপাতালের ভেতরের অধিকাংশ দরজায় তালা ঝুলানোর কারণে ভূতুড়ে পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
লালমনিরহাট রেলওয়ে হাসপাতালটি সঠিক নিয়মে না চলার কারণে এলাকার লোকজন অনেক বার প্রতিবাদ করলেও তেমন কোন লাভ হয়নি বলে জানান স্থানীয়রা।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ৩২ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালটিতে নারীদের জন্য ১০টি ও পুরুষদের জন্য ২০টি বেড রয়েছে সেই সাথে কর্মকর্তাদের জন্য ২টি বেড রয়েছে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালটিতে চিকিৎসক রয়েছে মাত্র ১ জন, সিনিয়র স্টাফ নার্স রয়েছে ১ জন ও অন্যান্য কর্মচারী রয়েছে ৩ জন। হাসপাতালে নেই একজন রোগীও।
কর্মরত নার্সের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাসপাতালে বর্তমানে একজন রোগী ভর্তি রয়েছে তাও আবার তিনি নিজ বাড়ি থেকে এসে চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন।
ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এই হাসপাতালের ভবনের ছাদ ও ওয়ালে ফাটল ধরেছে, জানালা-দরজার অবস্থা তেমন ভালো না। পাকা ছাদ বিধ্বস্ত, ইটের ফাঁকে ফাঁকে আগাছায় ভর্তি, এগুলো যেন দেখার কেউ নেই। হাসপাতালের ভবনের ভেতরে বা বাইরের পাশ দিয়ে চলতে গেলেও গা শিউরে ওঠে। দেখে মনে হয় ভুতুড়ে বাড়ি। পরিত্যক্ত ও বিধ্বস্ত মেডিকেল ভবনে অনেকটাই জীবনের ঝুঁকি নিয়েই কয়েকজন কে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য বসে থাকতে দেখে গেছে। শুধুমাত্র রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের রক্ষণাবেক্ষণ ও গুরুত্বের অভাবে মেডিকেল সেক্টরটির এমন অবস্থা বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
মূলত ডিভিশনাল মেডিক্যাল অফিসার এর কার্যালয় লালমনিরহাট থেকে ৪টি কেন্দ্র পরিচালিত হয়। লালমনিরহাট, তিস্তামুখঘাট, বোনারপাড়া, পার্বতীপুর। লালমনিরহাট ডিভিশনাল মেডিক্যাল অফিসার কার্যালয়ের তথ্য মতে বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল লালমনিরহাটে সরকারি মঞ্জুরী আদেশ (জিও) অনুযায়ী মঞ্জুরীকৃত পদ, কর্মরত পদ এবং শূন্য পদের সংখ্যাগুলো হলো:
চিকিৎসক ১ম শ্রেণী : মঞ্জুরীকৃত পদে রয়েছে ১০ টি, কর্মরত পদে রয়েছে ১ জন, শূন্য পদে সংখ্যা ৯ জন।
২ম শ্রেণী : মঞ্জুরীকৃত পদে রয়েছে ২৫ জন, কর্মরত পদে রয়েছে ১০ জন, শূন্য পদে সংখ্যা ১৫ জন।
৩ম শ্রেণী : মঞ্জুরীকৃত পদে রয়েছে ১৪ জন, কর্মরত পদে রয়েছে (শূন্য) জন, শূন্য পদে সংখ্যা ১৪ জন।
৪ম শ্রেণী : মঞ্জুরীকৃত পদে রয়েছে ১৮৫ জন, কর্মরত পদে রয়েছে ৭০ জন, শূন্য পদে সংখ্যা ১১৫ জন। ২৩৪টি পদের মধ্যে বর্তমানে ৮১টি পদে লোকবল কর্মরত রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ১৫৩টি পদই শূন্য রয়েছে যার ফলে চিকিৎসা কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল, লালমনিরহাট কেন্দ্রের বিভাগীয় চিকিৎসক কর্মকর্তা মঞ্জুরীকৃত পদের সংখ্যা একটি, কর্মরত পদের সংখ্যা শূন্য এবং শূন্য পদের সংখ্যা একটি। সহকারী সার্জন মঞ্জুরীকৃত পদের সংখ্যা : ৩ টি,কর্মরত পদের সংখ্যা একটি এবং শূন্য পদের সংখ্যা ২ টি।
লালমনিরহাট কেন্দ্রের সিনিয়র স্টাফ নার্স রোকসানা বেগম (৪৫) বলেন, মেডিকেলটি সচল থাকা অবস্থায় রোগী প্রচুর আসতো।এখন চিকিৎসক নেই, তাই রোগীও আসে না। অথচ যত জায়গা আছে তাতে ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল করা সম্ভব। এটি সচল করা গেলে রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাশাপাশি এ জেলার হাজার হাজার মানুষের চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব হবে। হাসপাতালটিকে সচল করতে সরকারের কাছে দাবিও জানান তিনি ।
মেডিকেল টেকনোলজিস্ট রেডিওগ্রাফীতে কর্মরত হুমায়ুন কবির (৪০) বলেন, যখন মেডিকেলের কার্যক্রম ভালো ছিলো ঠিক সেই সময় অধিকাংশ রোগী ওষুধের জন্য ও প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য আসতেন। বর্তমানে ইনডোরের চিকিৎসা সেবা নেই বললেই চলে। বলতে গেলে রোগীই ভর্তি থাকে না। এজন্য হাসপাতালটিতে কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে নতুন করে আবারো ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি আধুনিকায়ন করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ রেলওয়ে, লালমনিরহাটডিভিশনাল মেডিকেল অফিসার ডাঃ মাহফুজ ইফতেখার ভূঞা বলেন, এ হাসপাতালটির বৃটিশ আমলের মঞ্জুরিকৃত পদগুলো ঢেলে সাজানো দরকার। এতে সরকারের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার যে মূল লক্ষ্য তা বস্তাবায়ন হবে। চিকিৎসক ও জনবল সংকটের কারণে হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত। এমতাবস্থায় অনতিবিলম্বে জনস্বার্থে হাসপাতালের সমস্যাগুলো সমাধানে জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
বাংলাদেশ রেলওয়ে লালমনিরহাটের ডিভিশনাল ম্যানেজার মোঃ আব্দুস সালাম বলেন, জনবল বাড়ানোর জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। প্রয়োজনীয় জনবল পেলে হাসপাতালটি সচল হয়ে উঠবে। স্বাস্থ্য সেবা সুনিশ্চিত করতে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা চালিয়ে যাচ্ছি। কিছুদিনের মধ্যেই জনবল সংকট ও বর্তমান সমস্যা গুলো সমাধানের বিষয়ে কর্তৃপক্ষ গুরুত্বের সঙ্গেই দেখবেন।
আপনার মতামত লিখুন : :