বাউল বেশে দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ঘুরে বেড়ান দীনা মন্ডল। মায়াবী সুরে মাতোয়ারা করে তুলেন দর্শকদের। বাদ্যযন্ত্রের তালে নেচে-গেয়ে মঞ্চ মাতান এই শিল্পী। এভাবেই সুরে সুরে অল্প সময়েই পেয়েছেন আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। স্বপ্ন তার আকাশ ছোঁয়ার। দর্শকদের ভালোবাসায় নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে প্রথম সারিতেই তার স্থান।
দিনাজপুরে জন্ম এই বাউল শিল্পীর। জেলার নামের সঙ্গে নিজের নাম দীনা! এ যেন এক অদ্ভূত মিল। ছোট বেলা থেকেই সুরের প্রতি ঝোক ছিল তার। সময় পেলেই সুরের ছন্দে মেতে উঠতেন। তবে সেই সুর যে তাকে এতো দূর নিয়ে আসবে তা ভাবতেই পারেননি কখনো। সুরেই এনেছে জীবনের পরিবর্তন, সুরই দিয়েছে প্রিয় মানুষকে কাছে পাবার ঠিকানা।
সংগীতের আবহেই বেড়ে ওঠা দীনার। ছোট বেলা থেকেই গান শিখতেন দাদি আরজিনা বেগম আর নানা আকবর আলীর কাছে। বাউলের সঙ্গে শিখেছেন নজরুল সংগীতও। গানের তার প্রথম শিক্ষক ছিলেন নজরুল সংগীত শিল্পী ছিলেন মুজিবুর রহমান।
লালন গানের গুরুমুখী বিদ্যায় দীনার ওস্তাদ বাউল শাহাবুল। তার কাছ থেকেই গানের দীক্ষা নেয়া। দীনার দাদাগুরু হলেন বাংলার প্রখ্যাত শিল্পী শফি মন্ডল। চলার পথে এই শিল্পীর স্নেহ ও ভালোবাসা পেয়েছেন দীনা। আর এতেই চলার পথ হয় আরো প্রসারিত।
শফি মন্ডল বলেছেনও তার যোগ্য উত্তরসূরীদের মধ্যে একজন হবেন এই দীনা।
জীবনের গল্পে হয়তো এতো কিছু কখনো আশা করেননি দীনা মন্ডল। প্রথম জীবনে অবশ্য তার নাম ছিল দিলরুবা। সময়ের আবর্তনে দর্শকপ্রিয়তায় নাম বদলে হয়েছেন দীনা। সেই দিলরুবা আর এখনকার দীনার পার্থক্য আকাশ-পাতাল।
দিনা মন্ডল নাম হয়েছে মিসকিন শাহর দরবারে গিয়ে। তার গানে মুগ্ধ হয়ে আকবর আলী নামে এক লোক এই নাম দিয়েছিলেন ভালোবেসে।
গান শেখার পথে কলেজ জীবনে ইয়াকুব আলী নামে এক শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন দীনা। যার কাছ থেকেও শিখেছেন অনেক কিছু।
গ্রামের সহজ-সরল অচেনা মেয়েটি আজ শহুরে ঝলকানো আলোতে সবার পরিচিত মুখ। তাকে এক নজর দেখতে আর সুরের মায়ায় হারিয়ে যেতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন মানুষ। কণ্ঠে মায়াবী রসে ভরপুর। শুনলেই যেন হারিয়ে যাওয়া হয় ভাবের দুনিয়ায়।
সম্প্রতি কুষ্টিয়ার লালন মেলায় গান করে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন দীনা। বিমোহিত করেছেন দর্শকদের। মায়াবী সুরে মাতোয়ারা ছিলেন সব ভক্ত অনুরাগীরা।
তার গাওয়া গানের মধ্যে ‘কেন এতা মায়া মায়া লাগে, যে মারলো এই বুকে ছুরি, তার পেছনে কেন ঘুরি, এখনো সেই বৃন্দাবনে, যদি তরীতে বাসনা জাগে, সুখে থাকো সুজন বন্ধু, জীবনের ঐ পারে যদি আরেক জনম থাকে, শ্যাম তুমি লীলা বুঝো মন বুঝো না’ গানগুলো পেয়েছে সর্বোচ্চ জনপ্রিয়তা।
শুরুটা অবশ্য খুব বেশি দিনের না দীনার। অল্প সময়ের মধ্যেই গানের ভুবনে অবস্থান করে নিয়েছেন। জানান দিয়েছেন নিজের ভেতরকার প্রতিকার। আর এ নিয়েই পেয়েছেন আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা।
পেশাদারিত্বের সঙ্গে গানের শুরু ২০২০ সাল থেকে। তবে সে যাত্রা অনেকটা আটকে দেয় করোনা। তবুও থেমে থাকেননি দীনা। অনলাইনে করে গেছেন গানের আসর। এরপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ছন্দে ফেরান নিজেকে। স্টেজ পারফর্ম করে আসতে থাকনে আলোচনায়। নজর কাড়েন সবার। সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে তার মায়াবী সুর। আসতে থাকে গানের আরও বায়না। সেই যে তার পথ চলা আর থামতে হয়নি তাকে।
লালনগীতি, পল্লীগীতি, বাউল, মলয়া, রাধা-কৃষ্ণের প্রেম লীলা, বিচ্ছেদসহ সব ধরণের গানেই সমান পারদর্শী দীনা। সব গানেই তুলেন মায়াবী এক সুর। সেই সুরে যেন হারিয়ে যাওয়া যায় ভাবের দেশে। পাগলপারা সুরের মূর্ছনায় হৃদয় জয় করেছেন ভক্তদের।
তার এই অগ্রযাত্রার পেছনের কারিগর তার স্বামী মাহতাব হোসেন। অনুপ্রেরণা দিয়ে এগিয়ে নিয়েছেন দীনাকে। সার্বিক সফরযাত্রী হিসেবে কোন গান কখন মানুষের মন জয় করবে সেই দিকনির্দেশনা দেন তিনি।
কথা হয় তার স্বামীর সঙ্গে। মাহতাব বলেন, ‘দীনাকে আমি সর্ব্বোচ্চ জায়গায় দেখতে চাই। এ জন্য যা করার দরকার আমি করবো। জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও আমি তাকে গানের জগতেই রাখবো। তার সুরে অদ্ভূত এক মায়া রয়েছে। সেই ভুবন ভুলানো হাসি আর সুরে দর্শকদের পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে গানের জন্য ফোন করা হয়, এমনকি দেশের বাইরেও তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে, সেখান থেকেও আসছে গানের প্রস্তাব।’
গানের প্রসঙ্গে কথা হয় দীনা মন্ডলের সঙ্গে। এই শিল্পী বলেন, দর্শক-শ্রোতাদের ভালোবাসার কারণেই আজকে আমি দীনা। দেশ-বিদেশ থেকে অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগী আমার গান শুনেন এবং ভালোবাসা দেখান। পিছিয়ে যাওয়ার অনেক সুযোগ ছিল জীবনে কিন্তু অনেক বাঁধা আসলেও গান ছাড়িনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমার কণ্ঠে সুর থাকবে।
তিনি আরও বলেন, সুরের সাথেই আমি থাকতে চাই। এই পর্যন্ত আসার পেছনে আমার স্বামীর ভূমিকাও অনেক। তিনি আমাকে গান থেকে দূরে সরিয়ে দিলেও পারতেন। কিন্তু তা না করে আমাকে আরো সুযোগ করে দিয়েছেন। তবে নিন্দুকেরা আমার চলার পথ থামিয়ে দিতে চেয়েছিল, অদম্য চেষ্টার আর সাধনার বলে আমি এখনো টিকে আছি। দেশের মানুষ আমাকে ভালোবাসছে, এরচাইতে বড় পাওনা শিল্পীর জীবনে আর কিছুই থাকতে পারেনা। অনেক বড় বড় জায়গাতে গান করার সুযোগ হয়েছে আমার। জীবনে সব পেয়েছি। কোনো একদিন বিশ্বদরবারে বাংলার সুরকে ছড়িয়ে দিতে চাই আমি।
আপনার মতামত লিখুন : :