ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার পাহাড়িয়াকান্দি ইউনিয়নে অবস্থিত কলাকান্দি এইচ কে আছমাতুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয়। একসময় বাঞ্ছারামপুর উপজেলার উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে অবহেলিত অনুন্নত জনপদ ছিল পাহাড়িয়াকান্দি ইউনিয়ন। এই এলাকার শিক্ষা সংস্কৃতি এবং আর্থ সামাজিক উন্নয়নের কথা চিন্তা করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল খালেক। বড়কান্দি গ্রামের কৃতি সন্তান আবদুল খালেক পাকিস্তান আমলে জুট কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি ১৯৬৯ সালের ৬ জানুয়ারি তার মা আছমাতুন্নেছার নামে প্রতিষ্ঠা করেন কলাকান্দি এইচ কে আছমাতুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয়। শুরুর দিকে নিজের ব্যক্তিগত অর্থে ৪ একর জমি কিনে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরে আরও অনেকেই নানাভাবে স্কুলটিতে সহযোগিতা করেন।
শহীদ বুদ্ধিজীবী আবদুল খালেক যেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গত ১০ বছরে তা অনেকটাই ব্যহত হয়। তার একমাত্র কারণ স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. সিদ্দিকুর রহমান। তিনি সরাসরি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। স্থানীয় সাবেক এমপি ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম ও এমপির ভাগিনা জনি চেয়ারম্যানকে ম্যানেজ করেই বছরের পর বছর ধরে নানাবিধ অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে স্কুল থেকে লুটপাট করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বিগত সময়ে অযোগ্য ম্যানেজিং কমিটি এবং প্রধান শিক্ষক সিদ্দিকুর রহমানের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণে স্কুলের সমস্ত অর্জন ম্লান হয়ে যায়। গত ১০ বছরের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলই বড় প্রমাণ।
একসময় এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শতশত শিক্ষার্থী জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়ে পরবর্তীতে সাফল্যের চূঁড়ায় পৌঁছে যান এবং এলাকার সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে ভূমিকা পালন করেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শকুনের নজর পড়ে। সেই সাথে সিদ্দিকুর রহমান প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর শিক্ষার মান নিয়েও প্রশ্ন উঠে। অথচ বাঞ্ছারামপুর উপজেলার পাহাড়িয়াকান্দি ইউনিয়নের উলুকান্দি গ্রামের মোফাক্কের মোজাক্কের মোয়াত্ত্বের সাহেবদের পরিবার বাংলাদেশের অন্যতম একটি শিক্ষিত পরিবার। যেই পরিবারের কোন সদস্যকে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়নি। বিগত সময়ে রাজনৈতিক ম্যানেজিং কমিটি এবং রাজনৈতিক শিক্ষক দায়িত্বে থাকার কারণেই অপার সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠানটির আজকে এই বেহাল অবস্থা। আর সেই কারণেই এলাকাবাসী আজ সিদ্দিকুর রহমানের পদত্যাগের দাবি জানিয়েছেন।
বরাবরই বাঞ্ছারামপুর উপজেলার মধ্যে বাঞ্ছারামপুর এস এম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়, উজানচর কে এন উচ্চ বিদ্যালয়, রূপসদী বৃন্দাবন উচ্চ বিদ্যালয় কিংবা শাহরাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয়গুলো র্শীষে অবস্থান করে। সেখানে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ফলাফল সন্তোষজনক নয়। অথচ মেঘনার কোলঘেঁষা শান্ত সুনিবিড়, সবুজ সুন্দর ও মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে বিদ্যালয়টির অবস্থান। স্কুলের নান্দনিকতা এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ নিঃসন্দেহে সুন্দর, কিন্তু শিক্ষার মান ভাল নয়। তার কারণ প্রধান শিক্ষকের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা। বিগত সময়ে ম্যানেজিং কমিটি এবং প্রধান শিক্ষকের স্বেচ্ছাচারিতা নানাবিধ অনিয়ম এবং দুর্নীতির কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির আজ বেহাল অবস্থা। যদিও অতি সম্প্রতি স্কুলের সভাপতির পদে আসেন বাঞ্ছারামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবুল মনসুর।
কলাকান্দি এইচ কে আছমাতুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক মো. সিদ্দিকুর রহমান দীর্ঘদিন যাবত দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া সহকারি প্রধান শিক্ষক আব্দুল হাই মাসুদ, সিনিয়র শিক্ষক কাজী দুলাল মিয়া, আবুল কালাম আজাদ, সহকারি শিক্ষক মোহাম্মদ আলী, মো. ইব্রাহিম, আবু তালেব, মোহাম্মদ মজিবুর রহমান, আব্দুল্লাহ আল মামুন। খণ্ডকালিন শিক্ষক হিসেবে রয়েছেন জামান মিয়া, মো. সামছুল হক, মো. হানিফ মিয়া, আবু সাঈদ ও মোহাম্মদ আলী। অফিস সহকারি মতিউর রহমান, কম্পিউটার ল্যাব অপারেটর মো. নুর আলম, অফিস সহায়ক শাহাজালাল, প্রহরী আমান উল্লাহ, নিরাপত্তাকর্মী মো. আল আমিন, আয়া খাদিজা আক্তার এবং ঝাড়ুদার হিসেবে দায়িত্বরত হেলাল উদ্দিন।
কলাকান্দি এইচ কে আছমাতুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির বর্তমান সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবুল মনসুর। এছাড়া কো-অপ্ট সদস্য নাদিম মাহমুদ, অভিভাবক সদস্য কামাল হোসেন, মো. মাফুজুল ইসলাম, মেনটু মিয়া, লিটন মিয়া, সংরক্ষিত মহিলা অভিভাবক সদস্য শ্যামলী আক্তার, সাধারণ শিক্ষক প্রতিনিধি কাজী দুলাল মিয়া, সদস্য সচিব হিসেবে রয়েছেন মো. ছিদ্দিকুর রহমান। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মো. গাজীউর রহমান দাতা সদস্য।
অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক ও বিগত সময়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির বিরুদ্ধে বিদ্যালয়ের জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার প্রবেশপত্র বিতরণ, প্রশংসাপত্র বিতরণ, ব্যবহারিকের নামে টাকা আদায়, কোচিং বাণিজ্য, নির্দিষ্ট গাইড বই পাঠ্য করতে অর্থ গ্রহণ, সিলেবাস ব্যাচ বিক্রি ও ৬ষ্ঠ শ্রেণির ভর্তি ফরম বিক্রি করে টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সিদ্দিুকর রহমান প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর নির্বাচন হয়নি।
২০২৪ সালে যারা ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে নতুন ভর্তি হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে ৮শত ৫০ টাকা করে নেয়া হয়েছে। একইভাবে ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে যারা ৭ম শ্রেণীতে উঠেছে, তাদের কাছ থেকেও পূণরায় ভর্তি বাবদ টাকা নেয়া হয়। যা ধাপে ধাপে দশম শ্রেণী পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। সেই হিসেবে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ টাকা স্কুল ফান্ডে থাকার কথা। অথচ এই টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে।
স্কুলের শত বছরের পুরনো গাছ টেন্ডার ছাড়াই বিক্রী করা হয়েছে। তাছাড়া স্কুলের পুকুরটি কত টাকায় লিজ দেয়া হয়েছে তাও কেউ জানে না। স্কুলের রেজিস্ট্রারে গরমিল রয়েছে। গত ১০ বছরের আয় ব্যয়ের সঠিক হিসেব নেই।
স্কুলের লাইব্রেরিতে পর্যাপ্ত বই নেই। আসবাবপত্র, আলমারি, চেয়ার, টেবিলের নামে বিল ভাউচার করার অভিযোগ রয়েছে। বছরের পর বছর এভাবেই চলছে। এই বিদ্যালয়ে অর্থ তছরুপে অভিযোগের তীর বর্তমান প্রধান শিক্ষকের দিকে। গত ১০ বছরে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভয়াবহ অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। সাবেক এমপি ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলামের কারণে পার পেয়ে যান ছিদ্দিকুর রহমান মাস্টার। দুই একজন শিক্ষক এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে কথা বলার চেষ্টা করলেও তাদের দেওয়া হয়েছে বদলির হুমকি।
অনুসন্ধানে উঠে আসে, প্রতি বছর ভর্তির সময় ১৯টি খাতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা বেশি নেওয়া হলেও সেগুলো কিভাবে খরচ হচ্ছে তার কোন হদিস নেই।
সরেজমিন বিদ্যালয়ে গিয়ে বিভিন্ন শ্রেণীর ছাত্রদের সাথে কথা বললে এই তথ্যের সত্যতা মিলে। ভর্তির সময় স্কাউট, কমনরুম, রেড ক্রিসেন্ট, অত্যাবশকীয়, লাইব্রেরী, গবেষণাগার, কৃষি ও বাগান, চিকিৎসা সেবা ও বিবিধ খাতে লক্ষ লক্ষ টাকা আদায় করা হয়। অথচ এর কোনটির কার্যক্রম চলমান নেই। অত্যাবশকীয় ও কম্পিউটার সেবা খাতে যে টাকা নেওয়া হয় সেগুলো আদৌ কি কি কাজে ব্যয় হয় সে বিষয়টিও ছাত্রদের অজানা। এই খাত দুইটিতে গত কয়েক বছরে মোটা অংকের টাকা আদায় হলেও এগুলোর ব্যয়ের হিসেবেও নেই স্বচ্ছতা। অনুদানের অর্থও লুটপাটের অভিযোগ পাওয়া যায়।
বিদ্যালয়টির লাইব্রেরী ঘুরে কোন নতুন বই পাওয়া যায়নি। যে বইগুলো রয়েছে সেগুলোও চার পাঁচ বছরের পুরনো। কম্পিউটার ল্যাবে ওয়াইফাই সংকট। গত দুই বছরে মাত্র কয়েকদিন কম্পিউটার ল্যাবে এসেছে বলেও জানা যায়। বিজ্ঞানাগারেও সংকটের শেষ নেই। ক্যামিকেলের বোতল খুঁজে পাওয়া যায়নি। রাসায়নিক কি বিজ্ঞানের অনেক ছাত্র জানে না।
এদিকে তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২০২২, ২০২২-২০২৩ ও ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে এই বিদ্যালয়ে কম্পিউটার সামগ্রী, রাসায়নিক সামগ্রী, শিক্ষা উপকরণ, মনিহারী সামগ্রীসহ বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি ক্রয় বাবদ লাখ লাখ টাকা বরাদ্দ আসে। যার অধিকাংশ টাকা এসব সামগ্রী ক্রয় বাবদ উত্তোলন করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এই সবের কিছুই চোখে পড়েনি। এরমধ্যে গত তিন অর্থ বছরে গবেষণাগার সরঞ্জামাদি ক্রয়, শিক্ষা ও শিক্ষণ উপকরণ ক্রয়, বইপত্র ও সাময়িকী ক্রয়, কম্পিউটার, কম্পিউটার সামগ্রী, কম্পিউটার ও আনুষাঙ্গিক নানাখাতে অনিয়ম অব্যস্থাপনার চিত্র চোখে পড়ে। কেনাকাটায় কোটেশন দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা দেওয়া হয়নি। করা হয়নি ক্রয় সংক্রান্ত কোন কমিটি। ভুয়া বিল ভাউচারে অনুগত ২-১ জন শিক্ষকের স্বাক্ষর দিয়েই তুলে নেয়া হতো অর্থ। এতো অভিযোগের পরও বহাল তবিয়তে রয়েছেন সিদ্দিকুর রহমান। এলাকাবাসী তার পদত্যাগের দাবি করছে।
পাহাড়িয়াকান্দি ইউনিয়নের সচেতন মহল এই বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। একই সাথে সিদ্দিকুর রহমান প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর স্কুলের আয় ব্যয়ের সঠিক তদন্তের দাবি জানান।
আপনার মতামত লিখুন : :