কেউ কাটছেন পিতলের পাত। কেউ জোড়া লাগাচ্ছেন মুখ। কেউ আগুনে পুড়িয়ে ব্রাশ দিয়ে পরিষ্কার করছেন। আবার কেউ পরিপূর্ণ চুড়ি চকচকে করতে করছেন ঘষাঘষি। বিশাল এই কর্মযজ্ঞ চোখে পড়বে নওগাঁ শহরের দপ্তরীপাড়া মহল্লায়। যেখানে পিতল দিয়ে তৈরি হচ্ছে হাতের চুড়ি বা বালা।
স্বর্ণের দাম উর্ধ্বমুখী হওয়ায় ২০১২ সালে প্রথম পিতল দিয়ে চুড়ি তৈরি শুরু করেন দপ্তরীপাড়া স্বর্ণের কারিগর শেখ কামাল। প্রথমে একা কাজ করলেও বর্তমানে তার কারখানায় কাজ করে ১ হাজার শ্রমিক। যাদের অধিকাংশই নারী।
মাসে ৩৬ হাজার জোড়া চুড়ি তৈরি হচ্ছে কামালের কারখানায়। এসব চুড়ি সরবরাহ হচ্ছে ঢাকা, রাজশাহী, বগুড়া, নাটোর ও ফরিদপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। রপ্তানি হচ্ছে বিদেশেও।
স্বর্ণের মতোই দেখতে এ চুড়ি তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয় চায়না পিতলের পাত। ১ হাজার ৪০০ টাকা কেজি দরে কেনা পিতলের এই পাত আনা হয় ঢাকা থেকে। প্রতি কেজি চায়না পিতলের পাত থেকে ৩৮-৪০ জোড়া চুড়ি তৈরি করেন কারিগররা।
যেখানে ১ জোড়া চুড়ি তৈরিতে পাত, কেমিক্যাল, কাচা ধুপ, সরিষার তেল, গ্যাস, প্যান, বিদ্যুৎ ও শ্রমিকসহ খরচ পড়ে প্রায় ৬৫-৭০ টাকা। পাইকারি পর্যায়ে প্রতি জোড়া চুড়ি বিক্রি হয় ১৮০ টাকা থেকে ২০০ টাকায়। সে হিসেবে শেখ কামাল প্রতি মাসে অন্তত ৬৫ লাখ টাকার চুড়ি বিক্রি করেন। এক বছরে তার বাণিজ্য হয় প্রায় ৮ কোটি টাকা। যেখানে সব খরচ বাদেও শেখ কামালের বার্ষিক আয় হয় অন্তত সাড়ে ৪ কোটি টাকা।
এক সময় বেকার হয়ে ঘুরে বেড়ালেও গত দুবছর যাবত শেখ শিল্পালয়ে কাটিং মাস্টার হিসেবে কাজ করছেন রতন কুমার। প্রতি সপ্তাহে আয় করছেন সাড়ে ৩ হাজার টাকা।
গত ৫ বছর যাবত এ কারখানায় নকশার কাজ করছেন দপ্তরীপাড়ার গৃহবধূ ডেজী খাতুন। তিনি বলেন, স্বামীর মৃত্যুর পর সংসারের খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলাম। তখন কামাল ভাইয়ের এ কারখানায় প্রশিক্ষণ নিয়ে নকশার কাজ শুরু করি। শুরুতে সপ্তাহে ৬০০ টাকা পারিশ্রমিক পেলেও বর্তমানে প্রতি জোড়া চুড়ি তৈরি করে ১৫ টাকা থেকে ২৫ টাকা মজুরি পাই। বর্তমানে প্রতি সপ্তাহে ২ হাজার টাকা থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা আয় হয়। এখানে উপার্জিত আয় থেকেই বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। ছোট ছেলেকে স্কুলে পড়াচ্ছি।
তিনি বলেন, সম্ভাবনাময় এ শিল্পের প্রসার ঘটাতে পারলে দেশে কোনো যুবককে বেকার বা হতাশাগ্রস্ত হয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে না। হাজারো নারীর কর্মসংস্থান হবে। ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে তারা। তাই এই খাতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে পিতলের চুড়ি বিশ্বজুড়ে নওগাঁকে পরিচিত করতে সক্ষম হবে।
নওগাঁ বিসিক শিল্প নগরীর উপ ব্যবস্থাপক শামীম আক্তার মামুন বলেন, শেখ কামালের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে এ শিল্পকে ঘীরে পার্শ্ববর্তী রাণীনগর উপজেলায় আরো ৪ থেকে ৫টি নতুন কারখানা গড়ে তুলেছেন উদ্যোক্তারা। বর্তমানে সবকটি কারখানায় প্রতি মাসে অন্তত ৫০ হাজার জোড়া চুড়ি তৈরি হচ্ছে। এসব চুড়ি পাইকারি পর্যায়ে ১৮০ টাকা থেকে ২০০ টাকা এবং খুচরা পর্যায়ে ৩০০ টাকা থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি করছেন উদ্যোক্তারা। সেই হিসেবে জেলায় উৎপাদিত চুড়িকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর অন্তত ১০ কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছে। উদ্যোক্তা শেখ কামাল এসব চুড়ি বিদেশেও রপ্তানি করছেন। নিঃসন্দেহে পিতল থেকে চুড়ি উৎপাদন সম্ভাবনাময় একটি শিল্প। উদ্যোক্তারা এ শিল্পের প্রসার ঘটাতে চাইলে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণ সুবিধা দেওয়া হবে।
আপনার মতামত লিখুন : :