ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলা কৃষি অফিসের দুর্নীতির লাগাম টানা যাচ্ছে না কোনমতেই। বিগত সরকারের সময় রন্ধ্রে রন্ধ্রে সৃষ্ট সীমাহীন দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি এখানে চলে এসেছে স্বজনপ্রীতি, দল প্রীতির নজিরবিহীন অসংখ্য ঘটনা। তখন স্থানীয় এমপি ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলামকে ম্যানেজ করেই লুটপাটের মহোৎসব চালানো হয়েছে, এমন অভিযোগ স্থানীয়দের।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলার বর্তমান কৃষি কর্মকর্তা মো. নাসির উদ্দিন। বিসিএস ৩৪ ব্যাচের এই কর্মকর্তা ২০২২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বাঞ্ছারামপুরে যোগদান করেন। এখানে দুর্নীতি শুরু হয় ২০০৩ সালে অমিতাব দাস যোগদানের পরপরই। তিনি ২০০৭ সাল পর্যন্ত বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় কর্মরত ছিলেন। তবে দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে যান মো. জামাল হোসেন। সর্বশেষ বর্তমান কৃষি কর্মকর্তা মো. নাসির উদ্দিন গত ১৮ নভেম্বর অতীতের সমস্ত রেকর্ড ভঙ্গ করেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ২০২৪-২৫ মৌসুমে বোরো ধানের আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রনোদনা কর্মসূচীর আওতায় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক ৭ হাজার ১শত কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে হাইব্রিড ও উফশী ধানের বীজ ও রাসায়নিক সার বিতরণ করার কথা ছিল। এতে প্রতিজন কৃষক প্রতি বিঘা জমি চাষ করার জন্য বিনামূল্যে ২ কেজি হাইব্রিড বোরো বীজ, ৫ কেজি উফশী বোরো বীজ, ১০ কেজি এমওপি ও ১০ কেজি ডিএপি সার পাওয়ার কথা থাকলেও অনেকেই তা পাননি। তাছাড়া প্রকৃত কৃষকদেরও বঞ্চিত করার অভিযোগ উঠেছে।
গত ১৫ বছর বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় বিভিন্ন প্রজেক্ট বাস্তবায়নের নামে চলেছে সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থের হরিলুট। দুর্নীতির এই মহোৎসবে ভাগিদার হয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের দলবাজ নেতাদের অনেকে। কৃষকদের তালিকা প্রণয়ন, যাচাই-বাছাই, কৃষি প্রশিক্ষণ, সম্মানীভাতা, আপ্যায়ন খাতের দীর্ঘ তালিকা তো রয়েছেই। মোটা দাগে সরকার প্রদত্ত বিনামূল্যের (ভর্তুকি) সার, বীজ, কিটনাশক, বালাইনাশক, ভর্তুকির নগদ অর্থ প্রদান ইত্যাদিতেও পরতে পরতে রয়েছে দুর্নীতির গন্ধ। আর এসব দুর্নীতির মাধ্যমে লুটপাট হয়েছে সরকারি বরাদ্দের লাখ লাখ টাকা। সেই ধারাবাহিকতার লাগাম টেনে ধরার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না এখনও। বরং বিগত সরকারের রেখে যাওয়া দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেছেন বর্তমানে দায়িত্বপ্রাপ্তরা। দুর্নীতি এখনও রয়ে গেছে সমানতালে ধারাবাহিক নিয়মে।
বাঞ্ছারামপুরে কর্মকর্তা বদল হলেও বদলায়নি নানাবিধ দুর্নীতির চিত্র। অভিযোগ রয়েছে, সরকার অনুমোদিত ১৪ জন বিসিআইসি সার ডিলারদের কাছ থেকে কৃষি বিভাগের উধ্বর্তন কর্মকর্তাদের নামে মাসোয়ারা আদায় করা হয়। এছাড়া নানা দিবস ও অনুষ্ঠানাদি পালনের অজুহাতে মোটা অংকের অর্থ আদাই যেন রেওয়াজে পরিণত করেছে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ। এসব ডিলারদের বেশিরভাগই আবার রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে।
কৃষকদের মাঠ দিবস পালন অনুষ্ঠানে সরকারি তরফে বরাদ্দের ক্ষেত্রেও নেওয়া হয় দুর্নীতির আশ্রয়। কাগজে কলমে সব ঠিকঠাক থাকলেও বরাদ্দ বিতরণের সব খাতে চলে আসছে হিসাবের নয়ছয়। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও উপ সহকারি কৃষি কর্মকর্তাদের বেশ কয়েকজনের যোগসাজসেই বছরের পর বছর ধরে অনিয়ম ও দুর্নীতি চলছে। বেশ কয়েকজন উপ সহকারি কৃষি কর্মকর্তা দীর্ঘদিন একই কর্মস্থলে থাকার কারণে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।
বার্ষিক কৃষিমেলা উদযাপন, কৃষি প্রদর্শনী, প্লট বরাদ্দকরণ, কৃষকদের তালিকা প্রণয়ন, প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ, সম্মানীভাতা ও আপ্যায়ন খরচ নির্ধারণ, বৃক্ষ চারা বিতরণ, সার, বীজ, কীটনাশকসহ সবধরনের প্রণোদনের তালিকা চূড়ান্তকরণ, কম্বাইন হারভেস্টার মেশিনসহ অন্যান্য কৃষি যন্ত্রপাতি বিতরণ, বিসিআইসি সার ডিলারদের বাফার স্টক থেকে আমদানিকৃত সারের মজুদ ও বিপণন রেজিস্টার সবকিছুতেই অনিয়ম ও সীমাহিন দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় ১৪ জন বিসিআইসি সার ডিলার রয়েছেন। এসব সার ডিলারদের অনেকের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে চড়া দামে সার বিক্রি ও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ব্যবসা পরিচালনা করছেন কতিপয় ডিলার। অভিযোগ রয়েছে, প্রকাশ্যে নিয়মনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হলেও কোন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না ডিলারদের বিরুদ্ধে। উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নে ১৩ জন এবং পৌরসভায় ১ জন ডিলার নিয়েও স্বজনপ্রীতি হয়েছে। পুরো উপজেলায় ৭৪ জন খুচরা ডিলার রয়েছে। এসব ডিলার বিভিন্ন ধরনের সার সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে বিক্রী করছেন। তাছাড়া অনেকেই সার বিক্রির পর ক্যাশ মেমো দেন না। দীর্ঘদিন ধরে সার ডিলারদের নানা অনিয়ম ও সিন্ডিকেট ব্যবসা করলেও রহস্যজনক কারণে এসব ডিলারে বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি বাঞ্ছারামপুর কৃষি অফিস। যদিও সার ডিলার নিয়োগ ও বিতরণ সংক্রান্ত নীতিমালা অনুযায়ী, ইউনিয়নের জন্য নির্ধারিত সার ডিলার ওই ইউনিয়নে নিজস্ব গুদাম তৈরি করে সেখানে সার মজুত করবেন এবং সরকার নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি করবেন।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় ২০ জন বীজের ডিলার রয়েছেন। তবে অনেকের দোকান এবং বীজ সংরক্ষণাগার না থাকলেও পেয়েছেন বীজের ডিলারশিপ। বিগত সময়ে উপঢৌকনের বিনিময়ে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে ডিলারশিপ দেওয়া হয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়েছেন ডিলার নিয়োগ থেকে বঞ্চিত অনেক ব্যবসায়ী। নিয়ম নীতি লঙ্ঘন করে স্বজনপ্রীতি এবং উপঢৌকনের বিনিময়ে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের বাদ দিয়ে অব্যবসায়ীদের লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে। প্রতিটি সুপারিশের জন্য নেওয়া হয়েছে ৫০ খেকে ৬০ হাজার টাকা। আর লাইসেন্সের জন্য দিতে হয়েছে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। ফলে কৃষকের জন্য বরাদ্দ বীজ খোলাবাজারে বিক্রি হয়, এমন আশঙ্কা কখনও উড়িয়ে দেয়া যায়নি।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় খুচরা ও পাইকারি কিটনাশক ব্যবসায়ী রয়েছেন ৪৫ জন। এর বাইরেও অনেক অবৈধ কিটনাশক বিক্রেতা রয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব দেখভালের যেন কেউ নেই। বলতে গেলে বাঞ্ছারামপুর উপজেলা কৃষি অফিসের খামখেয়ালিপনা, দায়িত্বহীনতার কারণেই পুরো উপজেলার কৃষিখাতে নানাবিধ সমস্যা পরিলক্ষিত হচ্ছে। পাশ্ববর্তী হোমনা, মুরাদনগর, নবীনগর, রায়পুরা কিংবা আড়াইহাজার উপজেলায় কৃষি বিপ্লব ঘটছে। এদিকে বাঞ্ছারামপুরে কৃষিখাত অনেকটা থুবড়ে পড়ছে। আর এজন্য উপজেলার প্রকৃত কৃষকরা বাঞ্ছারামপুর কৃষি অফিসের স্বেচ্ছাচারিতাকেই দায়ি করছেন।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলা কৃষি অফিসের নানাবিধ অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের বিষয়ে উপজেলার প্রকৃত কৃষকরা সরকারের উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সঠিক তদন্তের মাধ্যমে বিগত সরকারের আমলে নেয়া সকল কার্যক্রম এবং আয়-ব্যয়, অডিট পরীক্ষা নিরীক্ষার দাবি জানান।
আপনার মতামত লিখুন : :